চড়তে থাকা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে দেশে জ্বালানি তেল আমদানির একমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাটিকেও চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। বিশ্ব বাজার অনেক বেশি ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়ায় বেশি দামে কিনে দেশের বাজারে কম দামে বিক্রির সেই পুরনো ধারায় ফিরতে হয়েছে বিপিসিকে।
আগের বছরগুলোতে তেলের পড়তি আন্তর্জাতিক বাজারে সরকার যেমন নিয়মিত দাম কমায়নি, তেমনি এখন অপরিশোধিত তেল ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে আরও চড়তে থাকলেও সমন্বয়ের পথে হাঁটছে না। এতে এতদিনের বাড়তি মুনাফায় ভাটা দেখা দিয়েছে। মাঝের বছরগুলোতে লাভের যে স্বস্তি ছিল তা উধাও হতে শুরু করেছে।
উচ্চমূল্যের জ্বালানির জন্য বিপিসির অর্থও লাগছে বেশি। আর যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জ্বালানির খরচ মেটাতে গিয়ে কিভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে লাভের টাকা তা ফুটে উঠেছে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ এর কথাতেও।
সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লস হয়েছে। বুঝতেই পারছেন লাভের অংক কোথায় যাচ্ছে? শুধুই দাম বাড়ছে।”
কোভিড মহামারীর সংক্রমণ কমে আসলে ২০২১ সালের শুরুর দিকেই বিশ্বজুড়ে বাড়তে থাকা চাহিদার জেরে ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে তেলের বাজার। বছরের শেষ দিকে তা আরও বাড়লে নভেম্বরে দাম সমন্বয়ে সরকার দেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করে।
যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে হু হু করে বাড়তে থাকে জ্বালানি তেলের দাম। ডিসেম্বরে অপরিশোধিত তেলের ব্যারেলপ্রতি দর ৬৫ ডলার থেকে বাড়তে বাড়তে মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২৪ ডলারে। এরপর সামান্য ওঠানামা করে সোমবার বিশ্ব বাজারে তা ১২০ ডলারের আশেপাশে বিক্রি হচ্ছে।
এর আগের কয়েক বছরে বিপিসির হিসাবকে সোনালী অধ্যায়ই বলা চলে। ভতুর্কির কারণে বছরের পর বছর লোকসান গোনা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত সাত অর্থবছরে জ্বালানি তেল বিক্রি করে মুনাফা করে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথমার্ধ শেষেও ভালো মুনাফাতেই ছিল।
তবে বিপিসির আকাশচুম্বী মুনাফার হিসাবে জট পাকাতে শুরু করে ইউক্রেইন ও রাশিয়ার যুদ্ধই। এ কারণে অর্থবছর শেষে লোকসান গোনার শঙ্কা প্রকাশ পেয়েছে বিপিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার কথাতেই।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ৮ মে পর্যন্ত হিসাবে দেখা যায় সংস্থাটির মুনাফা কমে ১২৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকায় নেমেছে। এখন প্রতিদিন ১০৮ থেকে ১১০ কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিপিসির চেয়ারম্যান আজাদ।
অথচ গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বিপিসির প্রকৃত মুনাফা ছিল ৯ হাজার ৫৫৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বলে ৯ জুন বাজেট উপস্থাপনের দিন প্রকাশিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রকাশনা ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা’র হিসাবে দেখা যায়।
বছর শেষে লোকসানে যাওয়ার আশঙ্কার বিষয়ে সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, গত ১০ দিনে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০ থেকে ১২ ডলার বেড়ে ১৭৪ ডলারে পৌঁছেছে। এ কারণে প্রতি লিটারেই বড় লোকসান দিতে হচ্ছে।
ডিজেলের সাম্প্রতিক দামের কথা উল্লেখ করে বিপিসি চেয়ারম্যান আজাদ জানান, এখন প্রতিদিন ১০৮ থেকে ১১০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।
“আপনি ধরেই নেন আগামী বছর আমাদের লাভের স্বপ্ন নাই।”
তবে এ পরিস্থিতিতে এখনও দাম বাড়ানোর কোনও প্রস্তাব সরকারকে দেওয়া হয়নি বলে জানান বিপিসির চেয়ারম্যান।
দাম বাড়ানোর কোনও প্রস্তাব করেছেন কি- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “না, এখনও আমরা করি নাই। সরকারকে মৌখিকভাবে বিভিন্নভাবে হালনাগাদ করে রাখছি এবং সরকারের কী পরামর্শ সে অনুযায়ী পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেব।”
বছরওয়ারি লাভ লোকসান
বিপিসির মুনাফা ও লোকসানের তুলনামূলক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সংস্থাটি গত ১৫ বছরে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে। আর সবশেষ সাত বছরে মুনাফার পরিমাণ ছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা।
২০০৭-২০০৮ থেকে ২০১৩-২০১৪ অর্থবছর পর্যন্ত বিপিসি শুধু এক অর্থবছরে মুনাফা করেছিল। বাকি ছয় অর্থবছর ছিল লোকসানে। এরপর ২০১৪-২০১৫ অর্থবছর থেকে টানা মুনাফা করতে শুরু করে।
কিন্তু তখন দাম কমানোর কথায় কান দেয়নি সরকার। বিপিসির লাভের মধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজার চড়তে থাকলে দাম সমন্বয়ে সবশেষ ২০২১ সালের নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা করে বাড়ানো হয়।
বিপিসির হিসাবে, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের ৩০ লাখ ৬৩ হাজার টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছে। এ সময় অপরিশোধিত তেল এসেছে ৮ লাখ ৭০ হাজার টন।
বাংলাদেশে ব্যবহার করা জ্বালানি তেলের ৭৩ শতাংশের বেশি ডিজেল। সড়ক ও নৌ পরিবহন, কৃষির সেচ পাম্প এবং বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানা ক্ষেত্রে ডিজেলের ব্যবহার রয়েছে।
আরও পড়ুন