এ বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে দরপত্রের প্রক্রিয়া শেষ হবে। পরে প্রস্তাব বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাকিটা ঠিক করা হবে, বলেন প্রতিমন্ত্রী।
Published : 11 Mar 2024, 05:58 PM
অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ‘আকর্ষণীয়’ মডেল পিএসসির আলোকে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আহ্বান করা দরপত্রে ‘ব্যাপক’ আন্তর্জাতিক সাড়া পাওয়ার আশা করছে সরকার।
সোমবার অফশোর বিডিং রাউন্ড-২০২৪ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমন আশার কথা তুলে ধরেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নীতি নির্ধারকরা।
গত রোববার (১০ মার্চ) দেশের নয়টি জাতীয় সংবাদপত্র, পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইট, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের সুযোগ দিয়ে দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। মাঝে ১৮০ দিন সময় দিয়ে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর সবার সম্মুখে দরপত্র উন্মোচন করা হবে।
এর পরদিন ঢাকার কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. নূরুল আলম ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার।
প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, “গভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে আমরা ইতোমধ্যেই ওএনজিসির সঙ্গে চুক্তি করেছি। বাকি ২৪টি ব্লকে এখন আমরা আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা শুরু করেছি।
“আমরা চাচ্ছি সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোম্পানিগুলো আমাদের এখানে আসুক। যারা ইতোপূর্বে খুব সাফল্যের সঙ্গে বিভিন্ন সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করেছে; আমরা উন্মুক্ত দর পদ্ধতিতে কাজটি তাদের কাউকে দিতে চাচ্ছি। ২০১৬ সালে আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। সমুদ্রে ডাটা প্রসেস করতে গিয়ে আমাদের তিনটি বছর লেগে গেছে। পরবর্তীতে কোভিডের কারণে আরও দুটি বছর পার হয়ে গেছে।”
বর্তমান জরিপ প্রতিবেদনের ওপর অনেক দেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমেরিকা ও এশিয়ার অনেক দেশ আগ্রহ দেখিয়ে গেছে। অনেকে ডেটা কিনছেন। … প্রতিযোগিতামূলকভাবে বাংলাদেশের প্রথম অফশোর বিডিংটা যেন অনুষ্ঠিত হয়। এ বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিডিং প্রসেস শেষ হবে। পরবর্তীতে প্রস্তাব বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা ঠিক করব।”
“কর্মকর্তারা প্রচণ্ড পরিশ্রম করে একটি আন্তর্জাতিক মানের মডেল পিএসসি তৈরি করেছে। কনসালটেন্ট কোম্পানি উড ম্যাকেনজি এখানে ভালো ভূমিকা রেখেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশের পিএসসিগুলো আমরা বিশ্লেষণ করে সেখান থেকে সহযোগিতা নিয়েছি। সবার সহযোগিতায় একটি ভালো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এই বিডিং প্রসেসটা শেষ করতে পারব বলে আমরা আশাবাদী।”
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, “এবারের মডেল পিএসসিতে অনেকগুলো নতুন নতুন বিষয় রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে বিডিংকে অনেক অ্যাট্রাকটিভ করা হয়েছে এবং দেশের জন্যও সেটা অনেক লাভজনক হবে। আমরা আশা করব বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখানে আগ্রহ দেখাবে।
“বাংলাদেশে কোনো বহুজাতিক কোম্পানি বিনিয়োগ করে বিফল হয়নি। তাদের যা পাওনা আমরা তা বারবার বুঝিয়ে দিয়েছি। সরকারের বাইরে আমাদের মধ্যে অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন যারা সব সময় পেসিমিস্টিক মন্তব্য করতে আগ্রহী। তাদের মুখে ছাই দিয়ে এবার একটি বিডিং রাউন্ড করা হয়েছে।”
কেন বিডিং রাউন্ড আকর্ষণীয়?
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে বিডিং রাউন্ডের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ।
তিনি জানান, এবার ৯টি অগভীর ও ১৫টি গভীর সমুদ্র ব্লকে মোট ২৪টি ব্লকে বিডিং রাউন্ড ঘোষণা করা হয়েছে। আইওসিগুলো এককভাবে অথবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে এক বা একাধিক ব্লকে আবেদন করতে পারবে। যারা যোগ্য বিবেচিত হবে তাদের সঙ্গে এই পিএসসির আলোকে চুক্তি করা হবে।
>> বিডিং রাউন্ড ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশের নয়টি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে এবং অর্থনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ইকনোমিস্টেও প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট, পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। ঢাকায় বিদেশি দূতাবাসগুলোতে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। এছাড়া বিদেশে বাংলাদেশে দূতাবাসগুলোতে অবহিত করা হচ্ছে। বিশ্বের খ্যাতনামা ৫৫টি আইওসির ইমেইল ঠিকানায় বিডিং রাউন্ডের তথ্য পাঠানো হয়েছে।
>> দরপত্র দাখিলের জন্য ১৮০ দিন সময় রাখা হয়েছে। আগামী ৯ সেপ্টেম্বর দাখিলের শেষ দিন। ওই দিনই দরপত্র উন্মুক্ত করা হবে।
>> সমুদ্রের ডেটা জানতে ‘মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে’ করা হয়েছে। প্রায় ১৩ হাজার লাইন কিলোমিটার পথ ঘুরে এ জরিপ করা হয়েছে। যেকোনো আইওসি চাইলে এই তথ্য কিনতে পারবে। ঈদের পরে প্রচারনা চালাতে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে।
এবারের বিডিং রাউন্ডের বেশ কিছু দিক তুলে ধরে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান বলেন, অনুসন্ধানের জন্য এবার ৯ বছর সময় দেওয়া হয়েছে। যদি তেলক্ষেত্র আবিষ্কার হয় সেটার মেয়াদ হবে ২০ বছর। আর গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হলে সেটার মেয়াদ হবে ২৫ বছর।
>> এখানে কোনো ‘সিগনেচার বন্ড বা রয়ালিটি’ কাউকে দিতে হবে না। এটাও এবারের বিডিং রাউন্ডের একটা আকর্ষণ। এবার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ব্রেন্ড অয়েলের ১০ শতাংশ এবং এটা আন্তর্জাতিক দামের সঙ্গে ওঠানামা করবে এমন শর্ত রাখা হয়েছে। তেল পেলে এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তেলের যে মূল্য আছে সেভাবে নির্ধারিত হবে।
>> যেকোনো যন্ত্রাংশ আমদানির ‘দায় সম্পূর্ণ পেট্রোবাংলা বহন করবে এবং সেটা হবে করমুক্ত। করপোরেট ট্যাক্স ‘লায়াবিলিটিও’ পেট্রোবাংলা বহন করবে। আগের পিএসসিগুলোর তুলনায় এবার ব্যাংক গ্যারান্টি একেবারে সামান্য রাখা হয়েছে, যাতে এটি আওসিগুলোর অংশ নেওয়ার ব্যাপারে কোনো বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
>> সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে কোথাও যদি সম্পদ পাওয়া যায় তাহলে তার ‘কস্ট রিকভারি’ হবে শতভাগ। এবং প্রতিবছর কস্ট রিকভারি সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ হতে পারবে। এতে যেকোনো বিনিয়োগকারী অতি দ্রুত তার বিনিয়োগ ফেরত পাবে। পরে তাদের সঙ্গে উৎপাদন বন্টন চুক্তি হবে।
>> এবারের পিএসসিতে এটা খুব স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ঠিকাদারের অসতর্কতা, চুক্তির কাগজপত্রের পদ্ধতির বাইরে কাজ করতে গিয়ে কোনো কাজ করতে গিয়ে গ্যাস ক্ষেত্রের বা কোনো ব্লকের ক্ষতি হলে এবিষয়ে ঠিকাদারকে দায়ী করা যাবে।
>> আগের পিএসসিগুলোতে ছিল উৎপাদনের ভিত্তিতে মুনাফা ভাগাভাগি। এবার এখানে নিয়ে আসা হয়েছে ‘আর ফ্যাক্টর’। ঠিকাদারদের কাছে এটির ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সূচক বোঝাতে ‘আর ফ্যাক্টর’ ব্যবহার করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে বলা হয়, এখনই ‘আর’ এর মান প্রকাশ করা হবে না।
>> গ্যাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অংশ পাওয়ার পর আইওসির যে শেয়ার থাকবে সেটা তারা প্রথমেই পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রি করতে বাধ্য থাকবে। পেট্রোবাংলা কিনতে অপারগ হলে সেখানে দেশি কোনো প্রতিষ্ঠান কেনার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে।
আরও পড়ুন...
বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র