এক দশক আগে সমুদ্রসীমা নিয়ে ঐতিহাসিক বিজয়ের পরও এখন পর্যন্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অগ্রগতি নেই বললেই চলে; ধুঁকতে থাকা জ্বালানি খাতে সুসংবাদ আসেনি।
Published : 05 Aug 2023, 12:59 AM
দীর্ঘ দিন পর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের পালে হাওয়া লেগেছে; নতুন উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) চূড়ান্তের কাজ যেমন চলছে, তেমনি জলভাগে একটি জরিপের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে- যা বাংলাদেশে এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলেছে সুপরিচিত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী এক কোম্পানিসহ আরও বেশ কয়েকটিকে।
এমন প্রেক্ষাপটে বছর কয়েক আগেও লোকসানের কথা বলে চুক্তির পরও সাগরে গ্যাস খোঁজার কাজ ছেড়ে যাওয়ার সেই পরিস্থিতি এবার বদলানোর আশা দেখছেন সরকারের নীতি নির্ধারকদের পাশাপাশি জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
পিএসসি সংশোধনের পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে 'মাল্টিক্লায়েন্ট টুডি সার্ভের' চলমান কাজের পর সাগরে তেল-গ্যাস থাকার সম্ভাবনার বিষয়ে বাস্তবিক তথ্য হাতে পাওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ায় তা আগ্রহী করে তুলেছে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিকে। এর আগে এতদিন সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে সরকারের আগ্রহ থাকলেও কোনো জরিপের তথ্য না থাকায় বাংলাদেশের আহ্বানে সেভাবে সাড়া দেয়নি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো (আইওসি)।
এবার নরওয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ ভেঞ্চার টিজিএস-স্লামবার্জার (এসএলবি) এর সার্ভের কাজ তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমকে গতিশীল করবে বলে মনে করছেন জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নতুন পিএসসির আলোকে গ্যাস অনুসন্ধানে নভেম্বর নাগাদ দরপত্র ডাকার বিষয়ে আশাবাদী। পিএসসি চূড়ান্তের পাশাপাশি দরপত্রের আগেই সমুদ্রে টুডি সার্ভের পূর্ণাঙ্গ তথ্য হাতে পাওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
তিনি বলেন, “সার্ভের সব তথ্য হাতে পাওয়ার আগে যদি বিডিং দেওয়া হয় তাহলে সমস্যা হবে। পূর্ণাঙ্গ তথ্য হাতে পেয়ে বিডিংয়ে যাওয়া বেটার।“
সমুদ্রে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধানে সুপরিচিত নাম যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সন মবিলের প্রস্তাব পাওয়া এবং এ নিয়ে আলোচনার কথাও জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেছেন, “এক্সন মবিলের অফারটা বিবেচনার মধ্যে আছে। আমরা একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে তাদের প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করব। তারপর তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এবার মনে হচ্ছে এক্সন মবিল বেশ সিরিয়াসলি এগিয়ে আসছে।”
গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দীর্ঘদিন ধরে তাগাদা দিয়ে আসছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অনারারি অধ্যাপক বদরুল ইমাম মনে করছেন, নতুন মডেল পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অনাগ্রহী বিদেশি কোম্পানিগুলোকে এবার আগ্রহী করে তুলছে।
বিশেষ করে এক্সন মবিলের এগিয়ে আসার তথ্য তুলে ধরে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এ কোম্পানির দক্ষতাকে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে যুক্ত করা গেলে তা বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে।
এক্সন মবিলের অফারটা বিবেচনার মধ্যে আছে। একটি কারিগরি কমিটি করে প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবেজ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ
আলোচনায় এক্সন মবিল
এক দশক আগে সমুদ্রসীমা নিয়ে ঐতিহাসিক বিজয়ের পরও এখন পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে অগ্রগতি হয়নি; ধুঁকতে থাকা জ্বালানি খাতে সুসংবাদ আসেনি। সবশেষ ২০১২ সালের পিএসসির মাধ্যমে কাজ করার সব আয়োজন এগিয়ে নিয়েও চারটি বিদেশি কোম্পানির মধ্যে তিনটি পরে ছেড়ে গেছে। এতে করে দেড় দশক ধরে বলার মতো কোনো অগ্রগতিই হয়নি।
চুক্তির পর রয়ে যাওয়া একমাত্র কোম্পানিটি অগভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে কাজ শুরু করতেও সময় নিয়েছে অনেক বেশি। চলমান কাজের অগ্রগতিতেও গতি কম। এরমধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে দেশ জ্বালানি সংকটে ভোগার মধ্যেও গত ১১ বছরে নতুন কোনো দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।
২০১৯ সালে আরেকটি ‘মডেল পিএসসি’ তৈরি করা হলেও তা লাভজনক না হওয়ার শঙ্কা এবং কোভিডসহ নানা কারণ আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোকে বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে আগ্রহী করে তুলতে পারেনি।
এতদিনের সেই জট এবার খুলতে শুরু করেছে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে পিএসসির পুরোনো শর্তগুলো সংস্কারের ফলে। আগের চেয়ে গ্যাসের দাম এবং ভাগাভাগির হিস্যা বাড়ানোর উদ্যোগ বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অনাগ্রহীদের আগ্রহী করে তুলছে।
গত জুলাইয়ের শেষ দিকে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে মডেল পিএসসি-২০২৩ অনুমোদন করা হয়।
প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে কাজ করা গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেনজির পরামর্শ অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে নতুন এ পিএসসি। পেট্রোবাংলার বিশেষজ্ঞদের প্রণয়ন করা ওই মডেলে সরকারের নীতিগত সায়ও মিলেছে, যা এখন চূড়ান্ত হওয়ায় প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মডেল পিএসসি অনুমোদন
সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে ধীরগতিতে সংসদীয় কমিটির উষ্মা
ভোলার ইলিশার কূপ থেকে পরীক্ষামূলক গ্যাস উত্তোলন
জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য কোম্পানি নির্বাচনের আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করার আগেই সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সুপরিচিত নাম এক্সন মবিল গভীর ব্লকগুলোতে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছে। এর অংশ হিসেবে সমুদ্রে জরিপের কাজও করতে চায় তারা।
সরকারের সবুজ সংকেত পেলে দুই-এক মাসের মধ্যে মার্কিন কোম্পানিটির সঙ্গে চূড়ান্ত আলাপ শুরুর জন্য প্রস্তুত পেট্রোবাংলা বলেও জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা।
নতুন মডেল পিএসসির আলোকে অনেকগুলো বিদেশি কোম্পানি আগ্রহ দেখাচ্ছে জানিয়ে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সন বা আরও অনেক কোম্পানি আমাদের কাছে আগ্রহ দেখিয়েছে। এক্সন আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছে দুইবার। তারাও আরেকটি সার্ভে শুরু করতে চায়।
প্রাথমিকভাবে এক্সন ১০ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চায় বলে জানান তিনি।
“এক্সন মবিলের অফারটা বিবেচনার মধ্যে আছে। আমরা একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে তাদের প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করব। তারপর তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এবার মনে হচ্ছে এক্সন মবিল বেশ সিরিয়াসলি এগিয়ে আসছে,” যোগ করেন তিনি।
টুডি জরিপের তথ্য হাতে পেলে দরপত্র- প্রতিমন্ত্রী
মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির পর বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়। পুরো বাংলাদেশকে মোট ৪৮টি অনুসন্ধান ব্লকে ভাগ করার পর স্থলভাগ বা অনশোরে ২২টি এবং জলভাগ বা অফশোরে ২৬টি ব্লক নির্ধারণ করা হয়।
সমুদ্রে ২৬টি ব্লকের মধ্যে স্থলভাগ থেকে ১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে এবং পানির গভীরতা সর্বোচ্চ ২০০ মিটারের মধ্যে থাকা ১১টি হল অগভীর ব্লক।
অপরদিকে স্থলভাগ থেকে ১৫০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত এবং গভীরতা সর্বোচ্চ ২০০০ মিটার পর্যন্ত এলাকার ১৫টিকে গভীর ব্লক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে অনশোরে ২২টি ব্লকের মধ্যে চারটিতে গ্যাস অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি তাল্লোর সঙ্গে পিএসসি রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী শেভরন ব্লক ১২, ১৩ ও ১৪ এলাকায় অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছে এবং তাল্লো পেয়েছে ৯ নম্বর ব্লকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব।
এছাড়া অফশোরের ব্লক ৪ ও ব্লক ৯ এ গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ভারতের তেলগ্যাস কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ ও অয়েল ইন্ডিয়া এর সঙ্গে পিএসসি হয়েছে। ২০১২ সালের পিএসসি অনুযায়ী কোম্পানিটি এখন কাজ করছে। আর ওই পিএসসি অনুযায়ী কাজ পেয়েও পরে ২০১৪ সালে চলে গেছে অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি সান্টোস ও সিঙ্গাপুরের কোম্পানি ক্রিস এনার্জি।
এরপর দক্ষিণ কোরিয়ার পসকো দাইয়ু করপোরেশন গ্যাসের অস্তিত্ব পেয়েও ২০১৬ সালে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও তা চুক্তির বাইরে হওয়ায় সরকার সম্মতি না দেওয়ায় তারা চলে যায়।
সেই থেকে নতুন করে এ কাজে আর দরপত্র ডাকা হয়নি। দীর্ঘ এ সময়ে নিজেদের গ্যাসের নতুন সরবরাহ না বাড়লেও ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে জ্বালানির আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে স্থলভাগের পাশাপাশি সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরুর দাবি জোরালো হতে থাকে। বর্তমান সরকার টানা তিন মেয়াদে ১৫ বছর পেরিয়ে এলেও এ খাতে অগ্রগতি হয়নি।
এর কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম নিম্নমুখী হওয়া এবং ভালো অংশীদারিত্ব না থাকাকে কারণ হিসেবে তুলে ধরে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে কাজে ভেড়ানো যায়নি- এমনটাই বারবার বলে আসছেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।
বৃহস্পতিবার নসরুল হামিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সমসাময়িক ও পাশের দেশগুলোর পিএসসির সঙ্গে মিল রেখে এবারের মডেল পিএসসি করা হয়েছে। আমাদের নিয়োগ করা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেনজি সমুদ্রে কূপ খনন নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বসে পরামর্শ করেছে। এখন মডেল পিএসসি সব ধাপ পার হয়ে চূড়ান্ত হচ্ছে।
দরপত্র আহ্বানের বিষয়ে তিনি বলেন, সমুদ্রে এখনও টুডি সার্ভে শেষ হয়নি। সার্ভের সব তথ্য হাতে পাওয়ার আগে যদি বিডিং দেওয়া হয় তাহলে সমস্যা হবে। পূর্ণাঙ্গ তথ্য হাতে পেয়ে বিডিংয়ে যাওয়া বেটার। সার্ভে শেষ করে দরপত্র আহ্বান করতে হয়তো নভেম্বর ধরে যাবে।
সাগরটাকে এভাবে ফেলে রাখলে চলবে না, আবার কেউ যদি লাভ করতে না পারে তাহলে তারা আসবে কেন?জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম
সমুদ্র তেল-গ্যাসের বিষয়ে ধারণা পেতে নরওয়ের টিজিএস ও যুক্তরাষ্ট্রের এসএলবি জানুয়ারি থেকে ‘মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে’ করছে। বিভিন্ন ধাপে ৩২ হাজার লাইন কিলোমিটার টুডি জরিপের কাজ তারা নিজেদের অর্থায়নে শুরু করেছে। বাংলাদেশ বিনামূল্যে জরিপ তথ্য পাবে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান পরে অনুসন্ধানে কাজ করবে তাদের কাছে জরিপের তথ্য বিক্রি করবে তারা। এ জরিপ কাজের একটা অংশের কাজ শেষের পর্যায়ে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ভূতত্ত্ববিদ বদরুল ইমাম পিএসসির শর্ত সংস্কারকে ইতিবাচক বর্ণনা করে বলেন, “বাংলাদেশে বহুদিন ধরে চেষ্টা করেও বিদেশি কোম্পানিগুলোকে আকর্ষণ করতে পারছিল না। তাই এই পরিবর্তনগুলোকে জাস্টিফাইড বলতে হবে। কারণ সাগরটাকে এভাবে ফেলে রাখলে চলবে না, আবার কেউ যদি লাভ করতে না পারে তাহলে তারা আসবে কেন?”
যুক্তরাষ্ট্রের এক্সন মবিলের আগ্রহের প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে গায়নায় কোম্পানিটির তেল অনুসন্ধানে সফলতার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, তারা তো গভীর সমুদ্রে কূপ খননের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অভিজ্ঞ। সুতরাং তাদের সঙ্গে যদি বর্তমান মডেল পিএসসি নিয়ে নেগোশিয়েশন করা যায় তাহলে সেটা বাংলাদেশের জন্যই ভালো। কারণ সবাই চাইবে ভালো কোম্পানি দিয়ে ভালো মানের কাজ হোক।
নতুন পিএসসিতে কী আছে?
বাংলাদেশের পিএসসির জন্য পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেনজি ভারত, মিয়ানমার, বুলগেরিয়া, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, সিয়েরালিওন ও পাপুয়া নিউগিনি এর মডেল পিএসসি'র সঙ্গে ‘বাংলাদেশ অফশোর মডেল পিএসসি ২০১৯' এর বিদ্যমান আর্থিক শর্তাবলীর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে।
পেট্রোবাংলার প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্টাক্ট বিভাগের পরিচালক মোঃ শাহীনুর ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, নতুন পিএসসিতে প্রাইস মেকানিজম ও প্রাইস ফ্যাক্টর পরিবর্তন করা হয়েছে। কস্ট রিকভারিতে আর্লি প্রভিশন রাখা হয়েছে। গ্যাসের প্রাইস করা হয়েছে ব্রেন্ট ইনডেক্সিংয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে। উৎপাদনে আইওসির (ইন্টারন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি) জন্য অংশীদারিত্ব মোটের ওপর ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। কস্ট রিকভারি যাতে তাড়াতাড়ি হয় সেই ব্যাপারটা এডজাস্ট করা হয়েছে।
বিডিং বা ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া যাওয়ার বিষয়টি সরকারি সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে জানিয়ে তিনি বলেন, এক্সন মোবিল সরাসরি আগ্রহ দেখিয়েছে। চীনসহ আরও কয়েকটি দেশের কোম্পানি তাদের মতো করে এবিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছে। আমরা আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। আগামী সেপ্টেম্বরের পর যেকোনো সময়ে এবিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হতে পারে।
“নতুন পিএসসিতে আমাদের স্বার্থ যেমন এখানে সংরক্ষিত হবে, তেমন তারাও লাভবান হবে। বলতে পারেন একটা উইন উইন সিচুয়েশন হবে,” বলেন তিনি।
কে কতটা পাবে?
এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তা শাহীনুর বলেন, বিশ্ব বাজারে এলএনজি দামের চেয়ে কোনো অবস্থাতেই যেন বেশি দামে আমাদের গ্যাস কিনতে না হয় সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। গভীর সমুদ্রের কূপের ক্ষেত্রে ফার্স্ট রিকভারির পর আমরা সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ পাব।
তিনি বলেন, গভীর সমুদ্রে ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা লাগতে পারে বলে আমরা হিসাব করেছিলাম। এখন এক্সন মোবিল বলছে, কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলার লাগবে। ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হলে তো ৫/৭ বছর লেগে যাবে বিনিয়োগ ফেরত পেতে। ওই সময় আমরা কমপক্ষে ৩৫ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ গ্যাস পাব। রিকভার হয়ে গেলে গ্যাস পাব কমপক্ষে ৬৫ শতাংশ।
“আমরা হিসাব করে দেখেছি, বিনিয়োগ যদি ৫ বিলিয়ন ডলার হয়, আর ইন্টারনাল রেট অফ রিটার্ন যদি ১২ শতাংশ হয় এবং ক্রুড অয়েলের দাম যদি ৭০ ডলারের ওপরে থাকে তাহলে বিনিয়োগ তুলতে ৫ থেকে ৭ বছর লাগবে। এই ক্ষেত্রে এক্সন মোবিল মনে করছে বিনিয়োগে কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে।
পিএসসির তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, অনুসন্ধানকারী কোম্পানির অংশের গ্যাস আগে স্থানীয় বাজারে অগ্রাধিকার পাবে। বাংলাদেশ নিতে অপারগ হলে তারা বাইরে বিক্রি করতে পারবে। আমরা পারমিট না করলে সে বাইরে বিক্রি করতে পারবেনা। তবে বিক্রির গ্যারান্টি আছে। আমরা না পারলে তাকে অবশ্যই বিক্রির অনুমতি দেওয়া হবে। বাইরে গ্যাস বিক্রি যদি লাভজনকও হয় সেক্ষেত্রে আমরা কিনতে পারলে সূত্র অনুযায়ী আমাদের কাছে বিক্রি করতে হবে।”
পিএসসিতে অনুসন্ধানকারী কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কেনার দর অপরিশোধিত তেলের বাজারদরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে; তা ব্রেন্ড ক্রুডের প্রতি ব্যারেলের দরের ১০ শতাংশ হবে।
উদাহরণ টেনে পেট্রোবাংলার এই কর্মকর্তা বলেন, ক্রুড অয়েলের মার্কেট ভ্যালু প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলারের নিচে গেলে তাদের লোকসান হবে। ক্রুড অয়েল ৭০ ডলার যখন থাকবে তখন আমাদেরকে প্রতি ইউনিট ৭ ডলারে তাদের অংশের ৩৫ শতাংশ গ্যাস কিনতে হবে। সেই হিসাবে ৫০ ডলারে নামলে ৫ ডলারে কিনতে হবে।
আগের যত পিএসসি-বিডিং রাউন্ড
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পিএসসি ১৯৭৪ এর আওতায় অগভীর সমুদ্র এলাকার ৬টি ব্লকের জন্য ৬টি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির সঙ্গে ৬টি পিএসসি স্বাক্ষরিত হয়। বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য তেল-গ্যাসের মজুদ সম্পর্কে তথ্য না থাকায় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো ব্লকগুলো ছেড়ে দেয়।
পিএসসি ১৯৮৮ এর আওতায় বিডিং রাউন্ড ঘোষণা করা হলেও কোন আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি এতে অংশগ্রহণ করেনি।
পিএসসি ১৯৯৩ এর আওতায় অক্সিডেন্টাল, পরবর্তীতে ইউনিকল এবং পরবর্তীতে শেভরনের সঙ্গে ৩টি ব্লক (ব্লক ১২ এবং ১৩ ও ১৪) এর জন্য ২টি পিএসসি স্বাক্ষরিত হয়। এগুলো বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে।
পিএসসি ১৯৯৪ এর আওতায় কেয়ার্ন এনার্জি পরে কেয়ার্ন এনার্জি ও শেল-এর জয়েন ভেঞ্চার এবং পরবর্তীতে সান্টোস এর সঙ্গে ২টি ব্লকের (ব্লক ১৫ এবং ১৬) জন্য দুটি পিএসসি হয়। ব্লক ১৫-তে কোন গ্যাস পাওয়া যায়নি। ব্লক ১৬-তে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় এবং ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গ্যাস উৎপাদিত হয়। গ্যাস ক্ষেত্রটির মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালে স্যান্তোস চুক্তির অবসান ঘটায়।
মডেল পিএসসি ১৯৯৭ অনুসরণে ঘোষিত বিডিং রাউন্ডের মাধ্যমে অনশোরের ৪টি ব্লকের জন্য ৪টি পিএসসি স্বাক্ষরিত হয়। বর্তমানে ১টি পিএসসি (ব্লক-৯; তাল্লো) বিদ্যমান রয়েছে।
মডেল পিএসসি ২০০৮ অনুসরণে ঘোষিত বিডিং রাউন্ডের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রের ব্লক ডিএস-১০ ও ডিএস ১১ এর জন্য কনোকোফিলিপস এর সঙ্গে ১টি পিএসসি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু আর্থিক শর্তাবলী তাদের বিবেচনায় অনুকূল না হওয়ায় ২০১৫ সালে তারা ব্লক দুটি ছেড়ে দেয়।
মডেল পিএসসি ২০১২ অনুসরণে ঘোষিত বিডিং রাউন্ডের মাধ্যমে অগভীর সমুদ্রের ব্লক এসএস-১১ এর জন্য স্যান্তো এর সঙ্গে ১টি পিএসসি স্বাক্ষরিত হয়। এশিয়া থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ায় তারা ২০২০ সালে ব্লকটি ছেড়ে দেয়।
অগভীর সমুদ্রের ব্লক এসএস-৪ ও এসএস-৯ এর জন্য ওএনসিজি বিদেশএর সঙ্গে স্বাক্ষরিত ২টি পিএসসি বিদ্যমান রয়েছে।
মডেল পিএসসি ২০১২ (বিশেষ বিধান আইনের আওতায়) অনুসরণে ব্লক ডিএস-১২ এর জন্য কোরিয়ার পসকো দায়ু এর সঙ্গে একটি পিএসসি সই হয়। কিন্তু আর্থিক শর্তাবলী তাদের বিবেচনায় অনুকূল না হওয়ায় পরে তারা ব্লকটি ছেড়ে দেয়।
অফশোর মডেল পিএসসি ২০১৯ এর আওতায় ২০২০ সালে বিডিং রাউন্ড আহ্বানের পরিকল্পনা করা হলেও কোভিড পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব হয়নি।