নোনা মাটিতে সোনা ঝরা দিন আনছে সূর্যমুখী

সারা বাংলাদেশেই সূর্যমুখী হয়, তবে উপকূলীয় এলাকায় এর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, বলছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

মরিয়ম সুলতানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2023, 07:33 PM
Updated : 20 May 2023, 07:33 PM

“আমি ২০ বছর আগে থেকে দেখছি, এই পতিত জমিতে কেউ চাষ-টাষ করত না। শুধু এক ফসল ছিল, আমন ধান। তারপরে গতবার কৃষি অফিসার আমারে দিয়া এইখানের এক বিঘায় সূর্যমুখী চাষ করাল। খুব ভালো ফলন হইল। আসলে আমরা কখনও ভাবি নাই যে এই জমিতে আমরা কোনোদিন তিন ফসল ফলাইতে পারব।” 

শুধু তিন ফসলের একটি হিসেবে সূর্যমুখী চাষ নয়, বাণিজ্যিকভাবে এ ফসল চাষে নামার কথা জানাচ্ছেন পটুয়াখালীর অসীম শিকারী। এবার তিনি সূর্যমুখী আবাদ করছেন প্রায় ১৬ বিঘা জমিতে। 

কলাপাড়া উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের এ কৃষক বলছিলেন, “আমরা এখন আমন ধান উঠায়ে ফেলার পর সূর্যমুখী ফালাই। তারপর আবার মুগডাইলও দেই। কেউ কেউ আবার সইরষাও দেয়।" 

গত বছর বিঘাখানেক জমিতে সূর্যমুখী চাষ করে প্রায় দেড়শ কেজি দানা (সূর্যমুখীর বীজ) পান অসীম। সেই চাষের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, "এক বিঘায় প্রায় ৬০০ গ্রাম বীজ লাগে। আর এক কেজি বীজের দাম ৩৫০০ টাকা। ব্র্যাক আমারে প্রায় ১২ কেজি, মানে ৩৬ হাজার টাকার বীজ দিছে, প্লাস বিঘাপ্রতি ১৫০০ কইরা টাকাও দিছে।” 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে বছরে ২৪ লাখ টন ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশে। 

কিন্তু এই তেলের বেশির ভাগ, প্রায় ৮৮ শতাংশ আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ভোজ্য তেল আমদানিতে খরচ হয়েছে ২৫৩ কোটি ডলার। 

বর্তমানে দেশে সরিষা, তিল ও সূর্যমূখী থেকে প্রায় ৩ লাখ টন তেল উৎপাদন হয়। বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল যাতে আমদানি করতে না হয়, সেজন্য সরকার ২০২৫ সাল নাগাদ ধানের উৎপাদন না কমিয়েই মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ, মানে ১০ লাখ টন তেল দেশেই উৎপাদন করার নানামুখী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের পরিচালক জসীম উদ্দিনের ভাষ্য, উপকূলের সেসব পতিত জমি আছে, তাতে সূর্যমুখী ও সয়াবিন চাষের বিপুল সম্ভাবনা আছে। 

“আমাদের দেশে সরিষাটাই প্রধান, তারপর সূর্যমুখী। সারা বাংলাদেশেই সূর্যমুখী হয়, তবে উপকূলীয় এলাকায় এর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। যেখানে লবণাক্ততা আছে এবং বোরো ধান করা সম্ভব না, সেখানে সূর্যমুখীটা হচ্ছে। 

“সমতল জমিতে সূর্যমুখীর জন্য জায়গা পাওয়া কঠিন। ওখানে সূর্যমুখী করলে বোরো করতে পারে না। আর লবণাক্ত জমিতে সরিষা ভালো হয় না, সয়াবিন এবং সূর্যমুখীটা বেশি হয়।” 

জসীম উদ্দিন বলেন, সয়াবিনের চেয়ে সূর্যমুখীর সম্ভাবনা বেশি, কারণ এটা সরাসরি ব্যবহার করা যায়। স্থানীয় পর্যায়ে যে ঘানিগুলো আছে, সেখানে ভাঙালেই কৃষক সূর্যমুখী তেল খেতে পারছে। কিন্তু সয়াবিন থেকে সরাসরি তেল হয় না। 

গতবার ১৫ কাঠা জমিতে সূর্যমুখী চাষ করলেও তেলের দাম চড়তে থাকায় এ বছর এক বিঘার বেশি জমিতে এর আবাদ করেছেন খুলনার কৃষক কালিপদ সরকার। 

কয়রা উপজেলার পাটুলিয়া গ্রামের এ কৃষক জানান, অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান কাটার পর মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার জন্য তার জমিতে অন্য ফসল হত না। ফলে বছরের বেশির ভাগ সময় জমি অনাবাদী হয়ে থাকত। 

গতবার তেমন জমিতেই সূর্যমুখী চাষ করে প্রায় ১২৬ কেজি সূর্যমুখী দানা পান তিনি, যা ভাঙিয়ে ৩৬ কেজির বেশি তেল পেয়েছেন। আর সেখান থেকেই আরও বেশি জমিতে সূর্যমুখী চাষের উৎসাহ পেয়েছেন। 

কালিপদ বললেন, “এবার গাছ হইছিল খুব সুন্দর। কিন্তু ফল যখন আইলো, ঠিক ওইসময় ঝড় আইসা সব নষ্ট করি দিয়ে গেছে। তারপরও গতবারের চাইতে এবার বেশি বীজ থাকবে। কিন্তু কয় মণ, তা এখনই বলতে পারতেছি না।" 

একই এলাকার ব্রতী রানী জানালেন, গত বছর তিনি ১০ কাঠা জমিতে সূর্যমুখী চাষ করেছিলেন। এবার আমন ধান কাটার পর প্রায় ৪ বিঘা জমিতে এ শস্য আবাদ করেছেন। 

“এই তেলটা খাঁটি, সুস্বাদু। নিজেরা করে খাচ্ছি, কোনো ভেজাল নেই। আর শুনছিলাম তেলের দাম বাড়তি, তাই এবার বেশি জমিতে দিছি। তাছাড়া আমাদের এই মাটিতে সূর্যমুখী খুব ভালো হয়।” 

সূর্যমুখীতে আশা 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রামের মতো উপকূলীয় এলাকায় অন্তত ৯ লাখ হেক্টর লবণাক্ত জমি আছে। এসব জমির বড় অংশ এক ফসলি, নয়তো পতিত জমি।  

তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের পরিচালক জসীম উদ্দিন বলছেন, "এই ৯ লাখ হেক্টর জমিতে যদি ঠিকভাবে চাষ করা চায়, তাহলে ১২ থেকে ১৩ লাখ মেট্রিক টন বীজ পাওয়া যাবে। আর তা ভাঙিয়ে শুধুমাত্র সেখান থেকেই ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন তেল পাওয়া সম্ভব। এখন ৪ লাখ যদি অতিরিক্ত তেল হয়, তাহলে এখান থেকে প্রায় ১৬ শতাংশ চাহিদা কাভার করা যাবে। 

"আমাদের প্রতি বছর চাহিদা হল ২৪ লাখ মেট্রিক টন। আর আমাদের দেশে তো অলরেডি ১০ শতাংশ হচ্ছেই। বাড়তি আরও ১৬ হলে মোট ২৬ শতাংশ তেল সহজেই দেশে উৎপাদন করা যাবে।" 

এ বছর দেশের ১৪ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী চাষ করা হয়েছে জানিয়ে জসীম বলেন, সরকারের লক্ষ্য হল ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশে মোট ৩৪ হাজার ৬০০ হেক্টর জায়গায় সূর্যমুখীর চাষ করা। তা সম্ভব হলে শুধু সূর্যমুখী থেকেই ৫৩ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন বীজ, অর্থাৎ ২০ হাজার ২৯২ মেট্রিক টন তেল পাওয়া যাবে।  

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২৮ দশমিক ৬ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ১০ দশমিক ৫৬ লাখ হেক্টর এলাকা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততা কবলিত। ফলে রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে ফসল চাষ অসম্ভব হয়ে পড়ে। ওই সময়ে নদীর পানির লবণাক্ততা ২৫-৩০ ডিএস/মি পর্যন্ত দেখা যায়। 

সূর্যমুখী তেল সংরক্ষণ পদ্ধতি

পটুয়াখালীর অসীম শিকারী বলেন, "বীজটা ভালো কইরা দুইটা কড়া রোদে শুকাতে হবে যেন মেশিনে দিলে গুঁড়ি হইয়া যায়। শুকানোর পরে ঘরে রাখতে হবে এক সপ্তাহ। এক সপ্তাহ ঘরে রাখলে বীজটা আস্তে আস্তে নরম হবে। তারপর ওটা ভাঙিয়ে তেলটা ৩০ লিটারের পটে রাখতে হবে। 

"দুই-তিন দিন রাখলেই নীচে একটা শানের মতো স্তর পড়ে। উপরে ভালো তেলটা উঠে যায়। তখন ওই তেলটা আমরা নামাইয়া ডোঙ্গা (খোলা পাত্রে) করে কড়া রোদে দিই, কিন্তু লবণ দিয়ে। যেমন ৩০ লিটার তেলে ১০০ গ্রাম লবণ দিই। লবণটা দিয়ে ভালো করে নাড়াচাড়া করে আমরা রোদে দিই।" 

অসীম জানালেন, তেলের ভেতরে ৪-৫ শতাংশ পানি থাকে। রোদে দিলে ওই পানিটা বাষ্প আকারে উড়ে যায়। 

“তারপর ওই তেলটা জুড়ালে আমরা বিকালে প্লাস্টিকের পটে রাখি, যা দুই বছর থাকবে। তারপর ওখান থেকে ২ বা ৫ লিটারের পটে পাইপ দিয়ে নামায়ে নামায়ে আমরা খাই। 

“নীচের যে স্তর, ওইটা আমরা সাদা সুতি কাপড়ে বেঁধে ঝুলায়ে রাখি। নীচে একটা পাত্র দিয়ে রাখি। এভাবে রাখলে ওই গাদের ভেতরে যত তেল থাকবে, ২৪ ঘণ্টার ভেতরে ফোঁটা ফোঁটা করে বালতিতে পড়ে যাবে। এটা আমাদের কাছে অতি সহজ প্রক্রিয়া। এভাবে আমরা ২ বছর রাখি।” 

ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির ঊর্ধ্বতন কর্মসূচি ব্যবস্থাপক তৌসিফ আহমদ কোরেশী বলেন, "বৈশ্বিক উষ্ণতা ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণেই উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে সমুদ্রের লবণ পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে এবং ভূগর্ভস্থ পানিতেও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে বাঁধ ভেঙে বা বাঁধ উপচে লবণ পানি কৃষি জমিতে ঢুকে পড়ে কৃষি জমির লবণাক্ততা বাড়িয়ে স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাহত করছে।"

এ পরিস্থিতিতে লবণসহিঞ্চু ফসল সূর্যমুখী চাষে কৃষকরা লাভবান হবে বলে মনে করছেন কৃষিবিদরা। 

খুলনার কয়রা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অসীম ‍কুমার দাশ বলেন, "দেখা যায়, আমন ধান কাটার পর অনেক জমি পড়ে থাকে। আর প্রায় ১২০০-১৩০০ হেক্টর জমি তরমুজে যায়। তবে আমরা এ বছর কয়েকজন কৃষককে দিয়ে তরমুজের আইলে সূর্যমুখীর চাষ করিয়েছি। আসলে একটা ফসল যদি হয়ে যায়, তখন ফসলটা দাঁড়িয়ে যায়। 

“গতবছর কয়রাতে মাত্র ২০ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী চাষ হলেও এবার সেটা বেড়ে হয়েছে ৯০ হেক্টর।”

ভালো দাম মিলছে না এখনও 

বাজার ঘুরে দেখা যায়, সয়াবিন, সরিষা, রাইস ব্র্যান ও সূর্যমুখীর মধ্যে সূর্যমুখীর দামই সবচেয়ে বেশি, তবে তা আমদানি করা বোতলের। এর মধ্যে ওলিটালিয়া, কিংসের মতো ব্র্যান্ডের ৫ লিটার সূর্যমুখী তেলের দাম পড়ে ২২০০ থেকে ২৪০০ টাকা; যেখানে ৫ লিটার রাইসব্র্যান তেলের দাম কোম্পানিভেদে ১০৫০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। 

একই পরিমাণ সরিষার তেল ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। আর দাম বাড়লেও এখনও ১০০০ টাকার মাঝেই মিলছে ৫ লিটার সয়াবিন। 

রাজধানীর পান্থপথের তেলের ডিলার ইসমাইল হোসেন বললেন, “আমরা ৫ লিটার সূর্যমুখী ১৭০০ টাকায় কিনি। খুচরা বাজারে এটা ২২০০ থেকে শুরু হয়। এইটার দামটা সবচেয়ে বেশি পড়ে, কারণ এটা সবাই খায় না। অধিকাংশ মানুষ এটা খায় ডাক্তারের পরামর্শে। আর যারা বিত্তশালী, তারা সূর্যমুখীর তেল খায়। ওই হিসাব তো আলাদা।" 

তবে প্রান্তিক পর্যায়ে সূর্যমুখীর দানা বা তেলের দাম সেভাবে মিলছে না বলে জানাচ্ছেন চাষীরা। 

কলাপাড়ার কৃষক অসীম জানালেন, এবার চাষের জমির পরিমাণ বাড়ালেও সূর্যমুখী দানা তিনি কোথায়, কার কাছে বিক্রি করলে ভালো দাম পাবেন তা বুঝতে পারছেন না। 

“সব ছোট ছোট কৃষকরা আমার দিকে তাকাইয়া আছে। আইসা বলে যে, ‘ভাই একটু ভালো দামে বীজ বিক্রি করা যায় কোথায়?’ আমরা অন্যান্য জায়গায় শুনি ৪০০০-৪২০০ টাকা মণ, কিন্তু আমাদের কাছে ৩০০০-৩২০০ টাকা মণ বলে কেন? ভালো পাইকারও আমরা পাই না। আগ্রহ কইরা কেউ কিনতেছে না। তাদেরকে একরকম  কইরা দেওয়া লাগে। এইরকম একটা ভোগান্তিতে আমরা আছি।" 

ভালো দাম নিশ্চিত করা গেলে দক্ষিণাঞ্চলে কোনো জমি পতিত থাকবে না মন্তব্য করে এই কৃষক বলেন, "সূর্যমুখী লাগাইয়া কি আমরা ঠকলাম? কারণ এখন পর্যন্ত বীজ কেনার জন্য এখানে কোনো লোক আসে না। যারা এলাকার পাইকার আছে, তারা কম দাম বলে। আমারে যদি কেজিতে কেউ ১০০ টাকা কইরাও বলে, তাও আমি হাসিমুখে আমার বীজ দিয়া দেব।“ 

ভালো দাম পাওয়া নিয়ে সংশয়ে খুলনার কালিপদও। তার কথায়, "ফলন ভালো হইলেও আমরা সূর্যমুখী বেশি লাগাই না, কারণ পরে যদি আবার বেচতে না পারি। সেইজন্যি আমাদের গ্রামের কৃষকরা মিষ্টি আলুটাই বেশি দিতে চায়।" 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জসীম উদ্দিন বললেন, কৃষকরা ভালো দামে বীজ বেচতে না পারার প্রধান কারণ হল এক্সট্র্যাকশন মেশিন ও মার্কেট লিংকেজের অভাব এবং অনুন্নত সুর্যমুখী বীজ। 

“আমরা জানি যে পাইকাররা বীজের দাম ৬০-৭০ টাকা কেজি বলে। এখন এই সংকট থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এক্সট্র্যাকশন মেশিন এবং মার্কেট লিংকেজ দরকার হবে। আমাদের দেশে যারা কিছুটা সূর্যমুখীর বীজ কিনছে, এদের সাথে আমরা লিংক করার চেষ্টা করছি। 

"কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল, ওরা যে সূর্যমুখীটা ব্যবহার করছে, তারা সেটা বাইরে থেকে আমদানি করে নিয়ে আসে। কারণ আমদানিকৃত সূর্যমুখীতে তেলটা বেশি বের হয়। হাইব্রিড হওয়ায় ওই বীজ থেকে ৪২-৪৩ শতাংশ করে তেল বের হয়। আর আমাদের দেশে যেগুলো হচ্ছে, সেটা যদি ঠিকভাবে চাষ না করা হয়, তাহলে দানাগুলো অপরিপক্ক থাকে। সেক্ষেত্রে ৩২-৩৫ শতাংশের বেশি বের হয় না। তাই ওখানে তাদের আগ্রহ বেশি।"

চাই বেসরকারি বিনিয়োগ 

বেশ কয়েক বছর ধরে সূর্যমুখী তেল উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে গ্লোব ফার্মা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব এডিবল অয়েল। 

সূর্যমুখী বীজ কোথা থেকে সংগ্রহ করেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে এ শিল্পগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুনুর রশীদ কিরণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বীজ আমদানি করে সেটা ভাঙায়ে তেল বানাই। ইউক্রেইন, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া থেকে সিড আসতো। এবারও ২/৪ টনের মত এনেছি। কিন্তু যুদ্ধের কারণে সিড অ্যাভেইল্যাবল না, দামও ডাবলের বেশি হয়ে গেছে। তাই আপাতত ৫-৬ মাস ধরে প্রোডাকশন বন্ধ।” 

সূর্যমুখী তেলে বিনিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, “এটা আমাদের অনেক বড় প্ল্যান, ২০০০ কোটি টাকার প্রজেক্ট। প্রতিদিন প্রায় ২০০০ টন সিড লাগে। সেখানে অন্তত ১০০০-১৫০০ টন সিড না হলে তো আমি মেশিন চালাতে পারি না।” 

কিরণ বলেন, “প্রতিদিন ২০০০ টন সিড তো ইমপোর্ট ছাড়া সম্ভব না। কিন্তু যেহেতু এখন ব্যাংকের সমস্যা আছে, কারেন্সিরও সমস্যা আছে, সিডের দামও হয়ে গেছে ডাবলের ওপরে, সেজন্য আমরা করতেছি না আর কি। কারণ মানুষ তো আর ডাবল পয়সা দেবে না। 

“এখন আমরা লোকাল পর্যায় থেকে কালেকশনের চেষ্টা করছি। তবে লোকাল পর্যায়ে যে সিড পাওয়া যায়, ওইটার দামও এখন বেশি। মার্কেটে ওইটা ৭০-৮০ টাকা চায় এখন। কিন্তু ৬০ টাকা হলে আমাদের জন্য সুইটেবল হয় আরকি। বাইরে থেকে আনলেও এখন এইরকমই পড়ে। কিন্তু বাইরেরটা আনলে তো আমি ৪৫ শতাংশ তেল পাচ্ছি। সেখানে লোকালটা থেকে পাচ্ছি ৪০ শতাংশ, দেশের সিডে অয়েল কন্টেন্ট কম।” 

মামুনুর রশীদ কিরণ বলেন, দেশে সূর্যমুখীর চাষ সেভাবে না হওয়ায় তারা ৯৫ শতাংশ বীজ বাইরে থেকেই আনতেন। 

“তবে এবার চাষ ভালো হয়েছে। বরিশালে যেগুলা হয়, ওইগুলার কোয়ালিটি শুধু ভালো। উপকূলীয় অঞ্চলে ওরা খুব ভালো প্রোডাকশন করে। তবে ওরা সেটা লোকালি ভাঙিয়ে তারপর মার্কেটে দেয়। সেক্ষেত্রে অত তেল পায় না। আমরা হলে তো ৪০ শতাংশর মতো তেল বের করতে পারি। দেশের সিডের আরেকটা সমস্যা হলো, দেশের বাজারে যেটা পাওয়া যায়, এটার খৈলটার কালারটা ভালো হয় না।” 

কৃষকদের সমস্যা লাঘবে সরকার বিভিন্ন এলাকায় সূর্যমুখী দানা ভাঙার যন্ত্র বিতরণ করতে যাচ্ছে জানিয়ে তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের পরিচালক জসীম বলেন, “১০০ টা মেশিন আমরা এক দুই মাসের মাঝে দেব। এমনিতে আমাদের যান্ত্রিকীকরণের প্রজেক্ট আছে। কিন্তু এগুলো খুব ছোট আকারে। ওই পারিবারিকভাবে ভাঙিয়ে খেতে পারবে। তবে প্রাইভেট সেক্টরে যদি বড় আকারে এক্সট্র্যাকশন মেশিন হয়, তাহলে চাষ আরও বাড়বে। 

"তবে এখানে সমস্যা হল, প্রাইভেট অর্গানাইজেশনগুলা জানেই না যে সূর্যমুখী থেকে বাণিজ্যিকভাবে তেল করা সম্ভব। যদিও আমরা প্রমোট করতেছি। আশা করি, তারা আস্তে আস্তে ইন্টারেস্টেড হবে।" 

ব্র্যাকের তৌসিফ আহমদ কোরেশীও সূর্যমুখীকে বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা দেখছেন না। 

তিনি বলেন, "এখন যেহেতু সয়াবিনের দামটা বেশি, তাই সূর্যমুখীর একটা মার্কেট তৈরি হওয়ার সুযোগ হচ্ছে। অনেকসময় আমরা দেখি যে প্রোডাকশন অনেক হয়, কিন্তু প্রোডাক্ট বেশি হওয়ায় মার্কেট ঠিক মত পাওয়া যায় না। 

"কিন্তু যেহেতু মার্কেটে সূর্যমুখীর পরিমাণ কম এবং দক্ষিণে এটা একটা ভালো অপশন, তাই আমরা বা সরকার, সবাই দক্ষিণের ওই জমি আরও এক্সপ্লোর করতে চাচ্ছি।”