শেভরনকে আরো দুটি গ্যাসক্ষেত্র দেওয়ার আলোচনা

পেট্রোবাংলার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্র এবং ১১ নম্বর ব্লকের জন্য তারা শেভরনের সঙ্গে আলোচনা করছেন।

রিয়াজুল বাশারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 August 2022, 07:19 PM
Updated : 23 August 2022, 07:19 PM

বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটের মধ্যে দেশে গ্যাসের উত্তোলন বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি শেভরনকে আরো দুটি গ্যাসক্ষেত্র ইজারা দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন-পেট্রোবাংলা।

রাষ্ট্রায়ত্ত এ কোম্পানির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্র এবং অনশোর ব্লক ১১-এর জন্য তারা শেভরনের কথা ভাবছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রশিদপুরের ব্যাপারে শেভরনকে বলা হয়েছে, আপনারা একটা কমপ্লিট প্রস্তাব দেন। আর ১১ নম্বরের ক্ষেত্রে আমরা বলেছি, আপনারা প্রস্তুতি নেন।”

১৯৬০ সালে আবিস্কৃত রশিদপুর বাংলাদেশের অন্যতম বড় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর একটি। আর অনশোর (ভূমি) ব্লক ১১-তে এখনো অনুসন্ধান চলছে।

৮ ও ১১ নম্বর ব্লকে যৌথভাবে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ২০২০ সালের নভেম্বরে জাপানের মিতসুই অয়েল এক্সপ্লোরেশন কোম্পানির (মইকো) সঙ্গে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) একটি সমঝোতা করে।

১১ নম্বর ব্লকে মইকো ও বাপেক্স থেকে এখনো নিশ্চিত কোনো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া না গেলেও ওই ব্লকে গ্যাসের মজুদ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শেভরনের ফিল্ড এরিয়ায় তারা কাজ সম্প্রসারণ করছে। এটা আগের প্রস্তাব। আমরা ওগুলো অনুমোদন করে দিয়েছি।

“আর রশিদপুরেরটা আমাদের এখনো লিখিত দেয়নি। তবে রশিদপুরে আমরা ড্রিলিংয়ে যাচ্ছি। ওরা যদি প্রস্তাব দেয়, আমরা বিবেচনা করতে পারি।”

শেভরন এর আগে রশিদপুর, ছাতক ও ১১ নম্বর ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু ছাতক গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতে বিবাদের বিষয়টি মাথায় রেখে পেট্রোবাংলা আপাতত ওই গ্যাসক্ষেত্র অন্য কাউকে ইজারা দিতে আগ্রহী নয় বলে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “১১ নম্বরের ক্ষেত্রে আমরা (শেভরনকে) বলেছি, আপনারা প্রস্তুতি নেন। জাপানের মইকোকে বলা হয়েছে, নভেম্বরের মধ্যে তাদের বিষয়গুলো চূড়ান্ত করতে।

“রশিদপুরের ব্যাপারে (শেভরনকে) বলা হয়েছে, আপনারা একটা কমপ্লিট প্রস্তাব দেন। জাস্ট সিম্পল একটা ইন্টারেস্ট আপনারা শো করেছেন, ঠিক আছে। কিন্তু এটা খুবই প্রাথমিক বিষয়।”

ওই কর্মকর্তা বলেন, তারা শেভরনকে দুইবার করে চিঠি দিয়েছেন, পেট্রোবাংলার সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে। তবে শেভরন এখনও কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব দেয়নি।

৮ ও ১১ নম্বর ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য জাপানের মইকোর সঙ্গে বাপেক্সের চুক্তি আছে। তাহলে সেখানে কীভাবে শেভরনকে সুযোগ দেওয়া যাবে তা জানতে চেয়েছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

উত্তরে পেট্রোবাংলার ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “এখনো কোনো অগ্রগতি সেখানে না থাকায় মইকোকে নভেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। বাপেক্সের সঙ্গে মইকোর একটা এমওইউ আছে। প্রতিষ্ঠানটি ৫-৬ বছর ধরে কাজ করছে। হঠাৎ করে বাদ দেওয়াটা ঠিক হবে না।

“আমরা বলেছি, আপনাদের (মইকো) যা করার আর দেরি করতে পারবেন না। আপনারা একটা প্রস্তাবে চলে আসেন। অন্যথায় ছেড়ে দেন।”

Also Read: ‘গ্যাস সঙ্কটের’ আঁচ বিদ্যুতে, বাড়ছে লোডশেডিং

Also Read: রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আনতে কমিটি গঠন

ওই কর্মকর্তা বলেন, “এমওইউতে ৮ ও ১১ নম্বর ব্লকের পুরোটা আছে। যেটুকুর মধ্যে তারা কাজ করতে চায়, সেটুকু বাপেক্সের সঙ্গে করতে পারবে। কিন্তু আমরা নভেম্বরের পরে আর সময় দেব না। হয় তাদের সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, না হয় ছেড়ে যেতে হবে।

“শেভরনকে বলছি, নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। তারা যদি পুরাটা ছেড়ে দেয় তাহলে পুরোটা, আর যদি আংশিক করে, তাহলে বাকি অংশের বিষয়ে আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারব।”

এসব বিষয়ে জানতে শেভরন বাংলাদেশের মুখপাত্র শেখ জাহিদুর রহমানকে প্রশ্ন করা হলে স্পষ্ট কোনো উত্তর তিনি দেননি।

বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে ২৫ বছর ধরে কাজ করার বিষয়টি তুলে ধরে ইমেইলে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “আজকের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আগামীর সম্ভাবনা খেুঁজে দেখতে আমরা সর্বদাই বাংলাদেশ সরকার এবং এ দেশের জনগণের সঙ্গে অংশীদারিত্বে আগ্রহী।

“তবে দীর্ঘদিনের নীতি অনুযায়ী আমরা সুনির্দিষ্ট এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করছি না।”

বাংলাদেশে মোট ২৮টি গ্যাসক্ষেত্রে রয়েছে। ভূমি ও সাগরে মোট অনুসন্ধান ব্লক রয়েছে ৪৮টি। এর মধ্যে ভূমিতে ২২টি ও ২৬টি সাগরে।

পেট্রোবাংলার হিসাবে, সোমবার দেশের ২০টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে মোট ২৩১১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার কথা। আর আমদানি করা এলএনজি থেকে আসবে আরো ৫৯৭ মিলিয়ন ঘনফুট।

দেশের গ্যাসের মধ্যে শেভরনের তিনটি ক্ষেত্র (বিবিয়ানা, মৌলভীবাজার, জালালাবাদ) থেকে উত্তোলন হবে ১৪২৪ মিলিয়ন ঘনফুট, অর্থাৎ ৬০ শতাংশের বেশি। বাকিগুলো থেকে আসবে ৪০ শতাংশ।

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে গ্যাসের চাহিদা বেড়েই চলেছে। কিন্তু দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উত্তোলন কমে যাচ্ছে। চাহিদা মেটাতে ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করছে সরকার। পরে কম-বেশি আরো প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করা শুরু হয়।

কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জ্বালানির দর উর্দ্ধমূখী হলে পহেলা জুলাই থেকে স্পট মার্কেটের এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। গ্যাসের স্বল্পতায় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ায় দীর্ঘদিন পর ফিরে আসে লোডশেডিং। এ কারণে দিনে এখন কয়েক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে দেশের মানুষকে।

দেশের গ্যাস উত্তোলনে মনোযোগ না বাড়িয়ে আমদানি করা নিয়ে এর আগে প্রশ্ন তুলেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। সরকারের তরফ থেকেও এখন দ্রুত গ্যাস উত্তোলনে জোর দেওয়া হচ্ছে।

দেশের সর্বপ্রথম গ্যাসক্ষেত্র হরিপুরে একটি কূপ খননে গত জুলাইয়ে চীনের সাইনোপেক ইন্টারন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম সার্ভিসেস করপোরেশনকে ঠিকাদারি দেওয়া হয়।

ভোলায় নতুন গ্যাসক্ষেত্রের কাজ দেওয়া হয়েছে রাশিয়ার গ্যাজপ্রমকে। শুক্রবার সকাল থেকে ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের টবগী ১ কূপের খনন শুরু করেছে গ্যাজপ্রম।

এই রুশ কোম্পানি পর্যায়ক্রমে সেখানে আরও দুটি কূপ খননের কাজ করবে বলে জানিয়েছেন বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী।

দেশে গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে আগামী তিন বছরের মধ্যে ৪৬টি নতুন অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।

সমুদ্রে বড় পরিমাণের গ্যাসের মজুদ রয়েছে বলে বিভিন্ন সংস্থা থেকে দাবি করা হলেও অনুসন্ধান বা উত্তোলনের কাজ আর এগোয়নি।

এখন সমুদ্রের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজে হাত দিতে উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) হালনাগাদ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

Also Read: ভোলায় একটি গ্যাস কূপে খনন শুরু, আরও দুটি করবে গ্যাজপ্রম

Also Read: গ্যাস সংকটে বন্ধ চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার

সরকারি হিসাবে বলা হচ্ছে, দেশে আবিস্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উত্তোলনযোগ্য ও প্রমাণিত মজুদ ২৮ দশমিক ৪২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। ১৯৬০ সাল থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়েছে ১৯ দশমিক ১১ টিসিএফ। অবশিষ্ট মজুদ ধরা হচ্ছে ৯ দশমিক ৩০ টিসিএফ।

এর মধ্যে রশিপুদপুরে ৩ দশমিক ১ টিসিএফ থেকে ৬৭৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে, অর্থাৎ এখনো প্রায় আড়াই টিসিএফ গ্যাসের মজুদ রয়েছে।

রশিদপুরে উত্তোলনের দায়িত্বে রয়েছে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড। এই ক্ষেত্র থেকে প্রতিদিন ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তোলার সক্ষমতা রয়েছে এবং সোমবার ৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলন করার ধারণা দিয়েছে পেট্রোবাংলা।

জ্বালানি নীতি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম মনে করেন, পেট্রোবাংলা না পারলে বিদেশি কোম্পানিকে দিয়েই গ্যাস ওঠানো উচিৎ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “রশিদপুরে প্রচুর রিজার্ভ রয়ে গেছে। আমি মনে করি (শেভরনকে) এটা দ্রুত দিয়ে দেওয়া উচিৎ। তবে অবশ্যই নেগোশিয়েশন করে।

“বর্তমান যে পিএসসিটা, অবশ্যই সেটার ভিত্তিতে নেগোশিয়েনটা করতে হবে। সেখানে এখনকার আন্তর্জাতিক মূল্যের ভিত্তিতে করলে তো হবে না।”

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানি বিষয়ক বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পালন করে আসা তামিম বলেন, “এখন ওরা (শেভরন) যদি না করে, পেট্রোবাংলা তো পারে নাই। এত বছর ধরে তারা ফেইল করল।

“আমাদের গ্যাসের ঘাটতি ২০০৭ থেকে। এরপর দেশের মধ্যে অনেক উত্তোলন বেড়েছে। এটা মেইনলি শেভরন বাড়িয়েছে। ২০০৭ থেকে ২০১৩ এর মধ্যে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট যে অতিরিক্ত আসছে, তার ৭০০ থেকে ৮০০ মিলিয়নই আসছে শেভরন থেকে। পেট্রোবাংলা কম বাড়িয়েছে।”

রশিদপুর থেকে পেট্রোবাংলা উৎপাদন বাড়ায়নি কেন- সেই প্রশ্ন তুলে ম. তামিম বলেন, “তার মানে, তারা পারে নাই।”

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশের অনশোরে যেসব জায়গায় গ্যাস আছে, সে জায়গাগুলো থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে গ্যাস উত্তোলনের চেষ্টা করছি আমরা। যেসব জায়গায় সম্ভাবনা আছে সেখানেও অনুসন্ধান, উত্তোলনের চেষ্টা চলছে। আমরা প্রায়োরিটি ভিত্তিতে গ্যাস উত্তোলন করে গ্রিড লাইনে আনার চেষ্টা করছি।”