মহাপরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির রূপরেখা স্পষ্ট নয়: সিপিডি

সুলভমূল্যে ক্লিন এনার্জি নিশ্চিতের তাগিদ গবেষণা সংস্থাটির।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Dec 2022, 02:11 PM
Updated : 22 Dec 2022, 02:11 PM

খসড়া পর্যায়ে থাকা সমন্বিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনাকে আগের চেয়ে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি। তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশল আরও বাস্তবসম্মত করার পরামর্শ এসেছে এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তরফে।

বৃহস্পতিবার ঢাকার ধানমণ্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মহাপরিকল্পনার বিস্তারিত পর্যালোচনা করেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

এর আগেও বিভিন্ন সময়ে তিনটি মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল সরকার। সর্বশেষ পরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য খাত থেকে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ নিয়ে আসার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা তিন শতাংশের ঘরে পড়ে আছে।

প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনাকে আগের চেয়ে ‘উন্নততর ও ইতিবাচক’ আখ্যায়িত করে মোয়াজ্জেম বলেন, “এর আগে তিনটি নীতিমালা হয়েছিল, যেখানে জাইকা অর্থায়ন করেছে। এবার ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকনোমি, জাপান কাজটি করছে। এবারের ইন্ডিগ্রেডেট প্লানে সব খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

“কার্বন সৃষ্টির প্রবণতা কমিয়ে আনা (লো কার্বনাইজেশন), এমনকি কার্বনের বিকল্পপথে হাঁটাও (ডিকার্বনাইজেশন) এবারের পরিকল্পনার একটা উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়েছে। এগুলো খুবই ইতিবাচক। এনভাইরনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্টকে এবার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, এটা আগে ছিল না। সেই হিসাবে এটা ইতিবাচক। এটাকে আইনগত বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।”

প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনাটি করা হয়েছে ২০৫০ সাল পর্যন্ত দেশের প্রবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক অবস্থা, শিল্পায়ন ও বিদ্যুতের চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে। সেই সময়ের মধ্যে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ৯০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ বা ৩৬ হাজার মেগাওয়াট ক্লিন এনার্জি বা ক্লিনার এনার্জি রাখা হবে বলে ভাবা হচ্ছে।

এই পরিকল্পনাকে উচ্চাভিলাষী হিসেবে দেখছেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক মোয়াজ্জেম।

“জিডিপি প্রবৃদ্ধির ভিত্তিতে ২০৫০ সালের মধ্যে ৯০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে বলে এই পরিকল্পনায় ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। এটি একটি অতি উচ্চাভিলাষী। ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি চাইলে ৩৬ হাজার মেগাওয়াট- নবায়নযোগ্য থেকে উৎপাদন করতে হবে। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা দিয়ে অর্জন সম্ভব না, সর্বোচ্চ ২২ হাজার মেগাওয়াট সম্ভব।”

তিনি বলেন, “লক্ষ্যমাত্রা যদি বাস্তবসম্মত হত, তাহলে ভালো হত। ধরুন বাস্তবসম্মত টার্গেট হচ্ছে ৪৫ হাজার, সেক্ষেত্রে ১৬ হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি অর্জন সম্ভব। বিদ্যুতের বাস্তবসম্মত টার্গেট থাকলে সেই অনুযায়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানিও উৎপাদন করা সম্ভব হত।”

বর্তমানে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্র ৬০ শতাংশ রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে সেটা ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। এই পরিকল্পনাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে সিপিডি।

‘খসড়া সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা (আইইপিএমপি): পরিচ্ছন্ন জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে কি?’ শিরোনামের এ অনুষ্ঠানে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন গোলাম মোয়াজ্জেম।

পরিকল্পনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য কার্বন ক্যাপচার টেকনোলজি স্থাপনের বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে নিলেও সন্দেহের কথাও জানিয়েছে সিপিডি।

“কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উপরে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি বসিয়ে সেটাকে ক্লিনার এনার্জি বলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা আসলে ঠিক নয়। বিশ্বব্যাপী কেউ কয়লাকে আসলে ক্লিনার এনার্জি হিসাবে ঘোষণা করছে না। এটা কনফিউশন সৃষ্টি করছে। এটা আরও বেশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে উৎসাহিত করবে।”

এবারের পরিকল্পনায় প্রতিবেশী দেশগুলোর পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নেওয়া হলেও সবুজ জ্বালানির ক্ষেত্রে এসব দেশের চেয়ে পরিকল্পনায় পিছিয়ে থাকার কথা জানান গোলাম মোয়াজ্জেম।

“থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ভারত, জাপানের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিকল্পনাকে রেফারেন্স হিসাবে সামনে রাখা হয়েছে। কিন্তু এসব দেশের মধ্যে ক্লিন এনার্জি পরিকল্পনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করলে পরিকল্পনায় বিভিন্ন দিক থেকে আমরা পিছিয়ে আছি।”

সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি পেতে হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়াসহ নতুন নতুন জ্বালানি সংযুক্ত করার পরিকল্পনা করলেও তা আপাতত স্থগিত রাখার পক্ষে মত দেয় সিপিডি। এসব প্রযুক্তি সংযুক্ত করার ফলে উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে গিয়ে তা নতুন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে বলেও আশঙ্কা গবেষণা সংস্থাটির।

“নতুন প্রযুক্তিতে যেই পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে, সেটা বাংলাদেশের জন্য নতুন মাথা ব্যাথার কারণ হতে পারে। তাই তুলনামূলকভাবে কম দামি প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করা দরকার। সেক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে।

“সেচ প্রক্রিয়াকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে নিয়ে যাওয়া, স্কুলগুলোকে রুফটপ এনার্জির দিকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে পরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে। আমরা বুঝতে চাচ্ছি- এগুলো স্বল্প মেয়াদি নাকি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তেল ও ডিজেলের দাম কমলে আমরা আবার যেন সেসব জ্বালানিতে ফিরে না যাই।”

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “সুলভমূল্যে যেন ক্লিন এনার্জি নিশ্চিত করা যায়, সেটাই আমাদের পরিকল্পনা। গত কয়েক বছর ধরে আমরা জ্বালানি ও বিদ্যুৎ নিয়ে গবেষণা করছি।

“জ্বালানি খাত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিল্প থেকে শুরু করে বাসাবাড়িতে এই বিদ্যুৎ জ্বালানির প্রয়োজন। বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে যেই দেশ যত ভালো করতে পেরেছে, তারা তত উন্নত হয়েছে।”

নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “মোট জ্বালানি উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র তিন দশমিক ৭ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে আটকে আছে। অথচ সেটা ২০২২ সালের মধ্যে ১০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা ছিল। এর মধ্যে আমাদের পুরোনো হাইড্রোকার্বনও যুক্ত হয়ে আছে।”