রিজার্ভ গণনার আইএমএফ পদ্ধতি জুন থেকে

বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাব করলে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ আরও কমে আসবে।

শেখ আবু তালেববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 March 2023, 04:15 AM
Updated : 20 March 2023, 04:15 AM

বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন গণনায় বিপিএম৬ পদ্ধতি আগামী জুন মাস থেকে বাস্তবায়ন করতে যাচেছ বাংলাদেশ ব্যাংক; জুন মাসে বছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে হবে।

ঋণের শর্ত পালনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশ নিল প্রথম কিস্তির টাকা হাতে পাওয়ার পর।

গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি প্রণয়ণে গঠিত কমিটির অভ্যন্তরীণ বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার একটি হারে নিয়ে আসা এবং ঋণের সুদহারের বেঁধে দেওয়া ৯ শতাংশের সীমা তুলে দিয়ে বাজারভিত্তিক সুদ ব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্তও হয় ওই বৈঠকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগামী জুন মাসে বছরের বাকি ছয় মাস সময়ের জন্য যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে, সেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনায় আইএমএফ এর বিপিএম৬ হিসাব পদ্ধতি বাস্তবায়ন করার বিষয়ে বিস্তারিত সিদ্ধান্ত জানানো হবে।”

তিনি জানান, বছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, আগামী জুন মাস থেকে বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভ গণনার তথ্য প্রকাশের পাশাপাশি বর্তমানে যে পদ্ধতি মেনে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ হিসাব করছে; সেই তথ্যও প্রকাশ অব্যাহত রাখা হবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবের রিজার্ভের তথ্য এবং বিপিএম৬ এর দুটি পদ্ধতির তথ্যই প্রকাশ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। যার যেমন তথ্য লাগবে তা নিতে পারবে।”

মহারীতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে এগোতে শুরু করলে আমদানির চাপ বেড়ে যায়। আমদানি খরচ বাড়লেও রপ্তানি আয় ততটা না বাড়ায় অস্থির হতে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার।

এতে বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ে ক্রমাগত চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে চলছিল বাংলাদেশের। এর মধ্যে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয় ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ। এর প্রভাবে মান হারাতে শুরু করে টাকা, মূল্যস্ফীতির পারদ বাড়তে বাড়তে ৯ শতাংশের ঘরে পৌঁছে যায়।

চলতি হিসাবের ঘাটতি পূরণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে গত বছরের জুলাইয়ে আইএমএফ এর কাছে ঋণ চায় বাংলাদেশ সরকার।

বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠকের পর গত জানুয়ারি মাসে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে বৈশ্বিক এ আর্থিক সংস্থা, যার প্রথম কিস্তি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে।

ওই ঋণের সঙ্গে বেশ কিছু কাঠামো ও নীতি সংস্কারের শর্ত আইএমএফ বেঁধে দিয়েছে, যার পরিপালন ইতোমধ্যে শুরু করেছে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা এবং রিজার্ভ গণনার পদ্ধতি পরিবর্তনের বিষয়টিও এর মধ্যে রয়েছে।

আইএমএফ এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব করার একটি নীতিমালা জারি করে এর নাম দেওয়া হয়েছে বিপিএম৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন)। বিশ্বে এটি বিপিএম৬ নামেই পরিচিত।

রিজার্ভ হিসাবের দুটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। একটি হচ্ছে গ্রস, অন্যটি নিট হিসাব। আইএমএফ এর পদ্ধতিতে হিসাব করলে বৈদেশিক সম্পদ গণনায় সকল বৈদেশিক দায় ও ঋণ এবং রিজার্ভের অর্থ অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করলে তা মূল রিজার্ভ থেকে বাদ যাবে।

বাংলাদেশ সরকার রিজার্ভের অর্থে ৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল গঠন ছাড়াও একাধিক তহবিল পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ বিমান ও শ্রীলঙ্কাকে কিছু অর্থ ঋণ দিয়েছে। আবার ইডিএফ ছাড়াও আরো দুটি তহবিল গঠন করে পরিচালনা করছে বৈদেশিক মুদ্রায়।

সব মিলিয়ে এর পরিমাণ ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের উপরে ছিল গত জানুয়ারি পর্যন্ত। এরপর ইডিএফ এর পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে এনেছে।

আইএমএফ এর হিসাব পদ্ধতি মানলে ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে বাদ দিতে হবে। এছাড়াও আরো দায় থাকলেও বাদ দিয়ে রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতিতে যেতে হবে বাংলাদেশকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগদ তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ জানুয়ারি দিন শেষে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম৬ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করলে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামবে।

বৈদেশিক মুদ্রার সংকট সামাল দিতে খরচ কমানোর জন্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যার ফলে চলতি অর্থবছরের ছয় মাস শেষে গত ডিসেম্বরে আমদানি ব্যয় ৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। আর নতুন এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ কমে সাড়ে ৫ বিলিয়নের ঘরে নেমেছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণের সুফল আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পওয়া যাবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সংকট সামাল দিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রির পাশাপাশি আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও নগদ উত্তোলনে বৈদেশিক মুদ্রার একাধিক বিনিময় হার বা রেট চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমর্থনে বাফেদা ও এবিবি।

আগে বিনিময় হার বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করলেও গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বিষয়টি বাফেদা ও এবিবি জানিয়ে দিচ্ছে।

বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে একক দর নির্ধারণের শর্ত জুড়ে দিয়েছে আইএমএফ। সেই শর্ত মানতে বিনিময় হার একটিতে নামিয়ে আনার উদ্যোগের কথা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

গত ১২ মার্চ বাংলাদেশ বিজনেস সামিটের একটি পর্বে তিনি জানিয়েছিলেন, শিগগিরই বিনিময় হার একটিতে নিয়ে আসা হবে। ওই নীতি বাস্তবায়নের প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এখন আগামী মুদ্রানীতিতেই তা জানানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করল বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া বেঁধে দেওয়া ঋণের ৯ শতাংশের সুদহারের সীমাও তুলে নিয়ে বাজারভিত্তিক ‘রেফারেন্স’ রেট বা একটি করিডোর করতে নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এটাও করা হচ্ছে আইএমএফ এর শর্ত পরিপালন করতে। এ ব্যবস্থায় সুদহারের একটি রেফারেন্স রেট বা সীমা বেঁধে দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক, তার সঙ্গে সর্বোচ্চ কত শতাংশ বাড়িয়ে ঋণের সুদ নির্ধারণ করা যায় তা ঠিক করবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ঋণের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে আমানতে সুদহারও।

বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণ প্রক্রিয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, “জুন মাসের মুদ্রানীতিতে বাজারভিত্তিক সুদহার সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত জানানো হবে।”

ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে অর্থ দিতে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় সরকার। তবে সম্প্রতি ভোক্তা ঋণে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ সুদ বাড়িয়ে নিতে মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখনো এ বিষয়ে কোনো সার্কুলার জারি হয়নি।