বাজেট প্রস্তাবের পর থেকে আলোচনা-সমালোচনায় ২ হাজার টাকা ন্যূনতম কর।
Published : 18 Jun 2023, 09:22 PM
করযোগ্য আয় না থাকলেও রিটার্ন জমায় সবাইকেই ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নিয়ে তুমুল বিতর্কের মধ্যে নতুন তথ্য দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
তিনি বলেছেন, যেসব নাগরিক ‘সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সেবা’ নেবেন, কেবল তাদেরকেই ন্যূনতম কর ২ হাজার টাকা দিতে হবে। যারা এসব সেবা নেবেন না, তাদের জন্য ন্যূনতম করের বাধ্যবাধকতা থাকবে না।
রোববার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি‘র বাজেট সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন মন্ত্রী।
গত ১ জুন অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট প্রস্তাবের পর থেকে ন্যূনতম ২ হাজার টাকার কর আরোপ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, “অংশীদারিত্বমূলক অংশগ্রহণ দেশের জনসাধারণের মাঝে সঞ্চারণের লক্ষ্যে করমুক্ত সীমার নিচে রয়েছে, অথচ সরকার হতে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে-এমন সকল করদাতার ন্যূনতম কর ২ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করছি।”
টিআইএন থাকলেই ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর নেওয়ার সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম পরদিন বলেছিলেন, যাদের ক্ষেত্রে টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক, সেই শ্রেণির মানুষদের জন্য এই ন্যূনতম কর বোঝা হওয়ার কথা নয়।
রিটার্ন দাখিলে দিতে হবে অন্তত ২০০০ টাকা, প্রস্তাব অর্থমন্ত্রীর
বাজেট ‘সময়োপযোগী হয়নি’, দুই হাজার টাকা ন্যূনতম কর ‘অযৌক্তিক’: সিপিডি
রিটার্ন দিলেই ২০০০ টাকা কর কেন, ব্যাখ্যা দিলেন এনবিআর চেয়ারম্যান
তবে সিপিডির সংলাপে এসে পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নান ২ হাজার টাকার ন্যূনতম কর প্রস্তাবের অন্য ব্যখ্যা দিয়ে বলেন, “নট ফর এভরিবডি, নট অল টিন হোল্ডারস। যে টিন হোল্ডার ট্যাক্স রিটার্ন দিতে চান, অথবা ফ্ল্যাট ফ্ল্যাট কিনতে চান, অথবা গাড়ি কিনতে চান, অথবা জমি কিনতে চান- এ রকম ৪০টি সেবার কথা বলা আছে...ওদের জন্য দুই হাজার টাকা।
“আমার টিন আছে, আমি রিটার্ন দিই না, আমি কোনও গাড়ি কিনি না, আমি ফ্ল্যাট কিনি না, কোনো সেবার জন্য যাই না সরকারের কাছে, আমাকে ২ হাজার টাকা দিতে হবে না।”
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট- পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীও বক্তব্য রাখেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
২০২৩-৪ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে প্রান্তিক মানুষকে রক্ষা করাই সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
“মূল্যস্ফীতি মোকাবেলার জন্য আমরা সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ভাতা বাড়াচ্ছি, কম দামে চাল, ডাল তেল বিক্রি করছি।… আমরা মধ্যবিত্তের কাছে সেভাবে যেতে পারছি না। তবে আমরা যদি অ্যাড্রেস করতে পারি, তাহলে উপরেও সেই কল্যাণটা আস্তে আস্তে যাবে।”
প্রস্তাবিত বাজেটে আয়কর রিটার্ন দাখিলে সহযোগিতার জন্য ‘ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন প্রিপেয়ারেটর বা টিআরপি’ নামে এজেন্ট নিয়োগের যে কথা উল্লেখ আছে, সেটি নিয়েও বক্তব্য রাখেন মন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আগে ইন্স্যুরেন্স এজেন্ট ছিল। এটাও সে রকম একটা প্রস্তাব। এখানে প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছে। যদি কেউ বুঝে সুঝে করে আনতে পারে, আনুক। এটা ভালো হলে আমরা রাখব। না হলে বাদ দিয়ে দেব। তবে এটা পাইলট আকারে হলেও করা উচিৎ। খারাপ হলে আমরা উঠিয়ে নেব।”
আগামী অর্থবছর থেকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমকে ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প’ উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, “আমাদের এই প্রস্তাব বিদেশের অনেকে পছন্দ করেছে। এই ধরনের বিরাট একটি প্রকল্প হাতে নেওয়ায় আমার নিজেরই ভয় হচ্ছে। বাট আমার ধারণা আমরা পারব।”
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অগ্রিম আয়কর কর কাটা বন্ধ হওয়া উচিৎ বলেও মনে করেন মন্ত্রী।
এর আগে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধূরী মূল্যস্ফীতি এবং ডলার সংকটসহ অর্থনৈতিক চাপের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দায়ী করেন।
সাবেক এই বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক লাখ কোটি টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিয়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। আবার রিজার্ভ থেকে ইডিএফ ফান্ড করে ঋণ দিয়ে রিজার্ভকে অপব্যবহার করার কারণে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে।”
সংলাপে জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, “বাজেট প্রণয়ণের সময় কোনো মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নেয় না অর্থ মন্ত্রণালয়। এমনকি মতামতও জানতে চায় না।”
তিনি বলেন, “আইএমএফ যেসব পরামর্শ দিয়েছে, এসব পরামর্শ আমরা অনেক আগেই দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের পরামর্শ না শুনে ডলারের বিনিময় হার বাজার মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়নি। টাকাকে পাকিস্তানি রুপির চেয়ে শক্তিশালী রাখাকে মানদণ্ড হিসেবে রেখে সুখ অনুভব করতে চেয়েছে। সম্প্রতি ডলারের দাম এক লাফে ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে এবং আমদানি পণ্যের মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করেছে।”
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী শিক্ষা উপকরণের ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাবের সমালোচনা করেন।
তিনি বলেন, “খাতা কিনতে হয় শিক্ষার্থীদের। সেখানে কলমের উপর আমরা ট্যাক্স বসিয়ে দিয়েছি। আমাদের দাবি ছিল বরাদ্দ বাড়িয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর। কিন্তু উল্টো এখন প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের ওপর ০.৬ শতাংশ হারে করপোরেট করের প্রস্তাব করা হয়েছে।
“ভিকারুন নিসা স্কুল সেটা হয়ত দিতে পারবে। কিন্তু গ্রামের একটা স্কুল তো দিতে পারবে না। তাকে যদি কোম্পানি আইনের অধীনে আনেন, তাইলে সে কী করে করপোরেট ট্যাক্স দেবে।”
মূল প্রবন্ধে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদ খাতুন স্থানীয় শিল্পের উৎপাদনের ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাবে আপত্তি তোলেন। বলপয়েন্ট কলমে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেন তিনি।