ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি শনাক্তের প্রক্রিয়া শুরু এপ্রিলেই, থাকছে যেসব ব্যবস্থা

বিদেশ ভ্রমণ ও কোম্পানি গঠনে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি বাড়ি, গাড়ি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 March 2024, 05:31 PM
Updated : 12 March 2024, 05:31 PM

ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের চিহ্নিত করতে এপ্রিলের প্রথমভাগেই আলাদা ইউনিট গঠনের নির্দেশনা দিয়ে এমন খেলাপিদের বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেগুলো ঠিক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

মঙ্গলবার এ বিষয়ক এ সার্কুলারে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণে এবং ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।

একইসঙ্গে বাড়ি, গাড়ি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধনের কর্তৃপক্ষের কাছে তালিকা পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থার আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হবে।

ওই ব্যক্তি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক থাকলে তা শূন্য ঘোষণা করা হবে।

অপরদিকে ঋণ পরিশোধের পাঁচ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবে না ইচ্ছাকৃত খেলাপী হওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

একই সঙ্গে কোনো ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে সেটিকে জরিমানার আওতায় আনার কথাও বলা হয়েছে সার্কুলারে।

এতে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণের মধ্যে থাকা বেনামি, জাল জালিয়াতি করে নেওয়া ঋণ, প্রতারণা ও ভিন্ন কাজে ব্যবহার করা ঋণও ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে।

এমন ঋণ খেলাপি চিহ্নিত করতে আগামী ৯ এপ্রিলের মধ্যে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা শনাক্তকরণ ইউনিট’ গঠন করার নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পরবর্তী দুই ধাপ নিচের কোনো কর্মকর্তাকে এ ইউনিটের প্রধান করতে হবে।

খেলাপি ঋণ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ব্যাংকিং খাতের ঋণ ব্যবস্থাপনার অন্যতম প্রধান অন্তরায় উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ‘‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা চিহ্নিতকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গৃহীত হলে শ্রেণিকৃত ঋণ হ্রাসসহ ব্যাংকিং খাতের ঋণ শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং ব্যাংকিং খাতের দক্ষতা, সক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।’’

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতার সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘‘এমন কোনো খেলাপি ঋণ গ্রহীতা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি যা- নিজের, তার পরিবারের সদস্যের, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির অনুকূলে কোনো ব্যাংক-কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে গৃহীত ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোন আর্থিক সুবিধা বা এর অংশ বা এর উপর আরোপিত সুদ বা মুনাফা তার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরিশোধ করে না।’’

এছাড়া ‘‘কোনো ব্যাংক-কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে নিজের, তার পরিবারের সদস্যের, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির নামে ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করলে।’’

যে উদ্দেশ্যে ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা এমন অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা নেওয়া হয়, সে উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে উক্ত ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা আর্থিক সুবিধা বা এর অংশ ব্যবহার করলেও তা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।

তালিকা চূড়ান্ত হবে যেভাবে

ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করার পর তা চূড়ান্ত করতে ওই গ্রাহককে নোটিস দিতে হবে। কোনো খেলাপি শনাক্ত হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে ইচ্ছাকৃত কি না, তার সিদ্ধান্ত নেবে এ সংক্রান্ত ইউনিট। যৌক্তিক কারণে সময় বাড়ানোর সুযোগও রাখা হয় নির্দেশনায়।

শনাক্তকরণের কারণ জানিয়ে ঋণ গ্রহীতাকে ১৪ দিন সময় দিয়ে জবাব দিতে বলা হবে। তবে শিল্প নীতিতে বর্ণিত সংজ্ঞানুযায়ী 'বৃহৎ শিল্প' খাতের ৭৫ কোটি ও তদূর্ধ্ব, 'মাঝারি শিল্প' খাতের ৩০ কোটি ও তদূর্ধ্ব এবং অন্যান্য খাতের ১০ কোটি ও তদূর্ধ্ব স্থিতির ঋণের বিষয়ে ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির/পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিতে হবে।

গ্রাহক চাইলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকে আপিল করতে পারবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।

যেসব নিষেধাজ্ঞায় পড়বে ইচ্ছাকৃত খেলাপি

  • বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি) এর কাছে কোম্পানি নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা দিতে চিঠি দিবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

  • ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাওয়ার যোগ্য হবেন না।

  • গাড়ি, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যাদি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে তালিকা পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

  • ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে ঋণ পরিশোধ করলেও পাঁচ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবে না ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

  • কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা হিসাবে তালিকাভুক্ত হলে তার পরিচালক পদ শূন্য হবে।

  • ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতার সংশ্লিষ্ট ঋণের আরোপিত বা অনারোপিত কোনো সুদ মওকুফ করা ও পুনঃতফসিল করতে পারবে না ব্যাংক।

  • খেলাপী হওয়া ঋণ অন্য কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি বা টেকওভার করা যাবে না।

  • পুরো ঋণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত ইচ্ছেকৃত খেলাপি হিসেবেই চিহ্নিত থাকবে।

এমন গ্রাহক শনাক্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করা বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথাও সার্কুলারে বলা হয়েছে।

কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা জরিমানা করা হবে। এছাড়া ধারাবাহিকভাবে নির্দেশনা লঙ্ঘন হলে প্রত্যেক দিনের জন্য অতিরিক্ত এক লাখ টাকা জরিমানা আরোপ হবে।

প্রতি তিন মাস পরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) ইচ্ছেকৃত খেলাপি ঋণের তথ্য প্রতিবেদন আকারে জমা দেওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।