এটা দুর্নীতি ধরার কমিটি না। এটা হল, দুর্নীতি কেন হয়েছে এবং দুর্নীতির মাত্রা কী সেটা বলবে, বলেন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
Published : 29 Aug 2024, 09:54 PM
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রকাশের কমিটি গঠনের পর এটির কাজ এবং এতে কী কী থাকবে তা নিয়ে আলোচনার মধ্যে কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, “এটা দুর্নীতি ধরার কমিটি না।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১২ সদস্যের এই কমিটি গঠন করে দেওয়ার পরদিনই বৃহস্পতিবার এ নিয়ে সভা করে করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে বৈঠক শেষে সংবাদমাধ্যমের সামনে আসেন কমিটির প্রধান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, “অনেকের কাছে ধারণা হয়েছে, এই কমিটি বোধহয় দুর্নীতি ধরার কমিটি, আমি আপনাদের পরিষ্কার বলে দিতে চাই এটা দুর্নীতি ধরার কমিটি না।
“এটা হল, দুর্নীতি কেন হয়েছে এবং দুর্নীতির মাত্রা কী সেটা বলবে। কিন্তু কে দুর্নীতি করেছে, কেন করেছে এটা বলা আমাদের দায়িত্ব না। এটা বলার জন্য সরকারের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান আছে।”
এ কমিটি মূলত সামষ্টিক অর্থনীতি ও খাতভিত্তিক অর্থনীতির অবস্থা এবং সামনের দিনের জন্য মতামত তুলে ধরবে বলেও জানান তিনি।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় বলেন, “আমরা এখানে (কমিটিতে) বিশ্লেষক, নীতি বিশ্লেষক এবং বিষয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে মতামত দেব।
“যে সমস্ত নীতিমালা চলছে, সেই নীতিমালা আমরা মূল্যায়ন করব। পূর্ববর্তী সরকারও কিছু নিয়ম ও নীতিমালা তৈরি করেছে, সেগুলোর প্রাসঙ্গিকতা এবং আগামী দিনের নতুন নীতিমালা করার ক্ষেত্রে কী হবে অথবা পূর্বের অবস্থার যেন পূনরাবৃত্তি না হয় তার জন্য রক্ষাকবচ কী হবে এইগুলো আলোচনার ভেতরে থাকবে।”
কমিটির কার্যক্রমের বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, কমিটি কোনো বিশেষ প্রকল্প বা কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিয়েও কাজ করবেন না। বরং অর্থনীতির অবস্থা বোঝার জন্য কোনো প্রকল্প সামনে চলে এলে বা ঋণখেলাপির মত বিষয় এলে তার মূল্যায়ন ও একই ধরনের পুনরাবৃত্তি সামনের দিনে না হওয়ার মতামত দেবে।
একই সঙ্গ কমিটি গণ আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের প্রায় সাড়ে ১৫ বছরের কাজেরও পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করবে না বলেও তুলে ধরেন তিনি।
কমিটির মূল কাজই হচ্ছে ‘ভিত্তিভূমি নিরূপণ’ বলে তুলে ধরে দেবপ্রিয় বলেন, “অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে উনাদের এই মুহূর্তে চ্যালেঞ্জগুলোকে চিহ্নিত করার প্রতিবন্ধকতাগুলো উপলব্ধি করা এবং পরবর্তী পদক্ষেপকে উনারা যদি রূপায়ন করতে চান তাহলে প্রথমেই বোঝা দরকার কোন ভিত্তিভূমির ওপর ওনারা দাঁড়িয়ে আছেন।
অর্থনৈতিক অবস্থার 'শ্বেতপত্র' তৈরি করবেন যারা
“আমাদের মূল কাজ হচ্ছে এই ভিত্তিভূমিকে নিরূপন করা, মূল্যায়ন করা এবং তথ্য-উপাত্ত দিয়ে এটাকে উপস্থিত করা। আমাদের এটিই কাজ।”
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয়ের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের এ কমিটি গঠন করার কথা বুধবার জানায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
কমিটিতে আরও এগারোজনকে সদস্যকে করা হয়েছে; তাতে প্রাধান্য পেয়েছে অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি খাতের গবেষকরা।
কমিটির প্রধান এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “শ্বেতপত্রটি একটি অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা আনার ক্ষেত্রে অনুশীলন। এটা স্বচ্ছতার অনুশীলন। এই স্বচ্ছলতার অনুশীলনের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার উপলব্ধি করবে তারা কী ধরনের উত্তরাধিকার নিয়ে অর্থনীতি পরিচালনার দায়িত্ব তারা পেয়েছেন।
“কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, এই ভিত্তিভূমি বা এই চ্যালেঞ্জের ঘটনাগুলো কেন হল এই আলোচনাটি আপনারা করবেন? হ্যাঁ আমরা কিছুটা করব, তবে সবটা করা ৯০ দিনের মাঝে সম্ভব না। সেহেতু প্রত্যাশা আমাদের একটু সীমিত করতে হচ্ছে পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে।”
এসময় তিনি বলেন, “আর একটা বিষয় থাকে, এই সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করার পরে এগুলোকে কীভাবে সমাধান হবে, সেগুলো কী আপনারা বলবেন? আমরা আবারও বলছি, এটাও আমরা কিছুটা বলব। ইঙ্গিত দেব। সরকারের সংস্কার কর্মসূচির জন্য অন্যান্য বিষয় সামনে আছে, কিন্তু এইটা ওই সংস্কার কর্মসূচিকে আরেকটু আলোকিত করবে।
“কোন পথে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোথায় খুব গুরুত্ব দিতে হবে। এইটা ততখানি সংস্কার কর্মসূচি দেবে না। সংস্কারের পথকে আলোকিত করবে। আর এর আগে, এই সমস্যা যেন আর কোনদিন উদ্ভব না ঘটে সেই ক্ষেত্রে রক্ষাকবচগুলোও উল্লেখ করা হবে।”
শ্বেতপত্র তৈরির উপায় কী?
এ বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন, “এর জন্য আমরা শুরুতেই যেটা করেছি, তথ্য-উপাত্তের অত্যন্ত একটি সমালোচনামূলক কিন্তু গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা তথ্য-উপাত্তের মূল্যায়ন করব। তথ্য-উপাত্তের মূল্যায়নের ভিত্তিতে আমাদের ভিত্তিভূমির পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করব।
“যদি তথ্য-উপাত্ত আমরা না পাই তাহলে এর বিকল্প তথ্য-উপাত্ত কী হতে পারে সেগুলোও আমরা বিবেচনা করব। সেগুলোও যদি না পাই তাহলে অনেকক্ষেত্রে আমরা এটার কার্যকারণ বিশ্লেষণ করব।”
তিনি বলেন, এটার মধ্য দিয়ে নবম পঞ্চমবার্ষিক পরিকল্পনা কী হবে, তার ভিত্তিটা কী হবে তার ইঙ্গিত থাকবে। ইঙ্গিত থাকবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তরান্বিত করার ক্ষেত্রে, আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার ক্ষেত্রে আরও কী কী করা যায়। একই রকমভাবে এলডিসির তালিকা থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের টেকসই বা মসৃণ উত্তরণের বিষয়েও দু-একটি কথা থাকবে।
তবে কোনো সংস্কার কাজ করা কমিটির কাজ না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তবে আমরা কোনো সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে বের হচ্ছি না। সংস্কার কর্মসূচি সরকারের ভেতর আলোচনা হচ্ছে, আগামী দিনে আরও হবে-ওই সংস্কারের কর্মসূচিকে একটা নির্দেশনা দেওয়া। কিছুটা পথপ্রদর্শনের জন্য তুলনামূলক গুরুত্ব বোঝানোর জন্য এই কমিটি কাজ করবে।
“এই সকল কাজ করার জন্য তিনটি পদ্ধতি চিন্তা করেছি। এক হল, তথ্য-উপাত্ত যা সরকারি থেকে আসে তার সমালোচনামূলক মূল্যায়ন আমরা করব। দ্বিতীয় হল, যে সব বিশ্লেষণ বিভিন্ন চিন্তক প্রতিষ্ঠান, বৈদেশিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোকে ব্যবহার করব। প্রশ্নহীনভাবে না, মূল্যায়নমূলক করব। তৃতীয়ত, বিভিন্ন অংশীজনের সাথে আলোচনা করব।”
ছাত্র-যুব সমাজের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এটি শুরু হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আলোচনার জন্য আমরা হয়ত ছাত্র-যুব সমাজের নেতৃবৃন্দ দিয়ে শুরু করব। বিদেশিদের সাথেও বসব। ব্যাবসায়ীদের সাথে বসব। ঢাকার বাইরেও করব, ঢাকায়ও করব। তবে এই অল্প সময়ের মাঝে এতকিছু রাখার আমাদের ইচ্ছা আছে, তবে আকাঙ্খাকে আমাদের লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্যবহার করার চেষ্টা করব।”
এ কমিটি অন্তর্বর্তীকালীন কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কোনো একটি বিষয়ের ক্ষেত্রে যদি আমরা মনে করি আমরা প্রস্তুত হয়ে গেছি, তাহলে এর একটা খসড়া আমরা প্রকাশ করে দেব।”
‘আগের সরকারের কাজের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন নয়’
বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে আগের সরকারের সুবিধাভোগীদের অর্থ আত্মসাতের নানান অভিযোগের বিষয়গুলো বিশ্লেষণের কাজ এ কমিটি করবে কিনা, এমন প্রশ্নে দেবপ্রিয় বলেন, “প্রজেক্ট ধরে আমরা এনালিসিসে যাচ্ছি না। আমাদের সুযোই নেই… কিন্তু সাধারণভাবে এডিপির উন্নয়নে যদি কোনো পরামর্শ থাকে তাহলে সেটি দুয়েকটা আমরা দিব।
“তবে মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করব। মেগা প্রজেক্ট আলোচনা করতে গিয়ে যদি কোন বিশেষ প্রজেক্টের ওপর মনোযোগ দিতে হয় তাহলে হয়ত আমার সহযোগীরা দেখবেন।”
দেবপ্রিয় বলেন, “এই রিপোর্ট বিগত সরকারের কাজের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন নয়। এটা মূলত বর্তমান সরকারকে সাহায্য করার জন্য, এগিয়ে যাওয়ার জন্য, এবং পূর্বে যেগুলো ভুলগুলো হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সেটার ব্যাপারে মনোযোগী করার জন্য করা হচ্ছে।”
ব্যাংকিং খাত বিষয়ে কমিটির কাজ কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন করব না। এটার জন্য সরকারের ব্যাংক কমিশন গঠনের চিন্তা আছে এবং আগামীতে এটা হবে বলে মনে হয়।”
তবে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের জন্য তারল্য পরিস্থিতি, বেনামি ঋণ, সঞ্চিতির ঘাটতি, পুঁজির ঘাটতি বিষয়াদি আসবে বলে তুলে ধরেন তিনি।
‘বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’ নামের এ কমিটি অংশীজনদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও মতবিনিময়ও করবে। আগামী ৯০ দিনের মধ্যে তারা সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন দেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে।
দেশের অর্থনীতিকে সুসংহত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেগুলোর একটি তালিকাও প্রস্তাব করেছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
সেগুলো হল- অর্থনীতি পুনরায় সচল করার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো নিরসনে কাঠামোগত সংস্কার; নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি; দুর্নীতি দূরীকরণ; ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা; কর ও শুল্ক নীতির সংস্কার এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ।