মোকাবেলায় আত্মপ্রত্যয়ী প্রধানমন্ত্রী, সংসদে জানালেন অগ্রিম পদক্ষেপের তথ্য।
Published : 08 May 2024, 08:37 PM
মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকট আরও ঘনীভূত ও দীর্ঘায়িত হলে তা দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, “বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টির যে আভাস দেখা যাচ্ছে, তা সারাবিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা যায়। দেশের অর্থনীতিতে এই সংঘাতের কিছুটা প্রভাব আসতে পারে।”
তবে সরকার এ বিষয়ে ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ গ্রহণ করবে বলেও আশ্বস্ত করেছেন সরকারপ্রধান।
বুধবার জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তরে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুলের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা।
অর্থনীতিতে সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব প্রশমনে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও তিনি তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব বাজারের অস্থিতিশীলতা, বাজার ব্যবস্থাপনায় অসামঞ্জস্য এবং বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এছাড়া সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে পণ্য সরবরাহের ‘সাপ্লাই-চেইন’ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইরান বা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে রপ্তানি সংশ্লিষ্ট পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেতে পারে। তাতে পণ্য তৈরি ও সরবরাহের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় রপ্তানিকারকরা কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে পারে বলে আভাস দেন তিনি।
মধ্যপ্রাচ্যের চলমান ঘটনাপ্রবাহের ওপর নজর রাখতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সংঘাত দীর্ঘ হলে কোন কোন সেক্টরে প্রভাব পড়তে পারে তা বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি।”
ফিলিস্তিনের গাজায় ছয় মাসের বেশি সময় ধরে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েল। সেই অভিযানে প্রাণ গেছে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের।
গাজায় ইসরায়েলের হামলার প্রতিশোধ নিতে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা গত ডিসেম্বরে লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা শুরু করে। এর জেরে বড় শিপিং লাইনগুলোর বেশির ভাগ জাহাজ এখন আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে যাতায়াত করছে। তাতে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ ও আমেরিকায় পণ্য পরিবহনে বেশি সময় লাগছে।
এই সঙ্কটের মধ্যেই গত ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরায়েল। তাতে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ কমান্ডারসহ কয়েকজন নিহত হন।
তার বদলা হিসেবে ইরান ইসরায়েলে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। পাল্টায় ইসরায়েলও ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরানে।
মধ্যপ্রাচ্যের ওই উত্তেজনা পুরো বিশ্বেই পণ্য বাণিজ্যে উদ্বেগ তৈরি করে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাও বিষয়টি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী সংসদকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো সংঘাত বা সংঘাতের খবর জ্বালানি তেলের বাজারকে প্রভাবিত করে। তাতে জাহাজ ভাড়া বাড়ে, যা আমদানি ব্যয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। সার আমদানিতে ব্যয় বাড়ে।
সে কারণে সারের বিকল্প উৎস হিসেবে চীন, মরক্কো, তিউনেশিয়া, কানাডা, রাশিয়ার ইত্যাদি দেশের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক আরও জোরদার করার কথা বলেন তিনি।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে টিসিবি কার্যক্রম সম্প্রসারণ বিষয়ক উদ্যোগের বিষয় নিয়ে সম্পূরক প্রশ্ন করেন ড. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল।
সেই প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “টিসিবিতে যে লোকবল আছে সেটা দিয়ে আমরা মানুষের যে সেবা করে যাচ্ছি সেটাই যথেষ্ট। আর সাধারণ মানুষের যাতে কষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়র বিষয়টি স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বিশেষ করে যারা সীমিত আয়ের, তাদের জন্য কষ্ট হচ্ছে। তবে গ্রামে যারা নিজেরা উৎপাদন করতে পারেন বা করছেন, তাদের জন্য খুব একটা কষ্ট নেই। হাহাকারও নেই।
“তারপরও আমাদের সবসময় প্রচেষ্টা, যেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকে। যার জন্য যথাযথভাবে যে যে পণ্যের প্রয়োজন সেটা দেশে যেমন উৎপাদনের পদক্ষেপ নিয়েছি। পাশাপাশি আমদানিও করে যাচ্ছি, যত টাকাই লাগুক না কেন, আমরা খরচ করে যাচ্ছি। আমাদের রিজার্ভেও চাপ পড়ছে। মানুষের কল্যাণ হচ্ছে আমাদের সব থেকে বড় কথা। সেদিকে আমরা লক্ষ্য রাখছি।”
সরকার দলীয় এমপি মাহফুজুর রহমানের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় সারাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে এবং জনসাধারণ উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার সুফল ভোগ করতে পারছেন।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আবুল কালামের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের কষ্ট লাঘবে সরকার ‘সবসময় সচেষ্ট’।
“সরকার নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্য স্বাভাবিক রাখতে সব প্রকার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিকে অনেকাংশে সংযত করতে পেরেছি।”
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারের কয়েকটি পণ্য– যেমন জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, গম, সারসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য, ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামালের মূল্য বাড়ায় দেশে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ অনুভূত হচ্ছে।
“পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘাতের ফলে সংকট ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে এ পরিস্থিতেও আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের ওপর এর প্রভাব প্রশমনে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
শেখ হাসিনা বলেন, “টাকার বিনিময় হারের সাম্প্রতিক পতন অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনার জন্য শীঘ্রই ক্রলিং পেগ ভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় নীতি গ্রহণ করা হবে। নির্ধারিত করিডোর ভিত্তিক এ ব্যবস্থা বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের অস্বাভাবিক উত্থান-পতন রোধ করবে বলে আশা করা যায়। ফলে এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক হবে।
প্রধানমন্ত্রীর এই লিখিত প্রশ্নোত্তর সংসদে উপস্থাপনের আগেই বুধবার বিকালে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু হওয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকা থেকে এক লাফে সাত টাকা বেড়ে ১১৭ টাকা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মূল্যস্ফীতির উপর বাহ্যিক প্রভাব কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বিলাস দ্রব্য বা অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের এলসি মার্জিন শতভাগ পর্যন্ত বর্ধিত করা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের এলসি স্থাপন সহজ করা হয়েছে।”
স্বতন্ত্র এমপি আবদুর রউফের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি পর্যালোচনাধীন আছে।
সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে পদক্ষেপ নিয়ে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হকের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সরকারপ্রধান বলেন, “আমাদের ট্রাফিক পুলিশ দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে। তাদের ঈদ বা ঝড় বৃষ্টি রোদ বলে কিছু নেই। তারা তাদের কর্তব্য পালন করে যান। কিন্তু মানুষের সচেতনতা না এলে কী করবেন?
“হেলপার যদি গাড়ি চালায় বা যার লাইসেন্স নেই, কে কখন কোনো গাড়িতে বসে চালাতে শুরু করে এটা তো বোঝাও দুষ্কর। আর এভাবে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। এরা নিজেও মরে যাত্রীদেরকে মারে।”
দেশে ব্যক্তিগত গাড়ি বৃদ্ধি পেয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। আমরাও গাড়ি কেনার সুযোগ দিয়েছি মানুষকে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও সুযোগ দিয়েছি।
“এখন আমাদের গাড়ির সংখ্যা এত বেশি কিন্তু সেই তুলনায় ড্রাইভারের সংখ্যা খুব কম। আমরা চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নিচ্ছি। এখন শুধু হাতে কলমে ট্রেনিং নয়, একেবারে কম্পিউটারাইজড। এটা ডিজিটাল সিস্টেমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যাতে লাইসেন্স দেওয়া হয়, সেই পদক্ষেপ আমরা নিচ্ছি।”
শেখ হাসিনা বলেন, যাদের ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই, তারা যেন সেটা চালাতে না যান। কারণ সেটা করতে গেলে তা হবে আত্মঘাতী।
“এই আত্মঘাতী ব্যবস্থা থেকে মানুষকে বিরত রাখতে হবে। এ ব্যাপারে সকলে সচেতন ও সোচ্চার হলে এটা অনেকটা কমবে। তারপরও বলব, দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। এটা আমাদের দেশ বলে নয়, সারা বিশ্বে অন্য দেশে যান, কী পরিমাণ মানুষ দুর্ঘটনায় মারা যায়। এটা খুবই দুঃখজনক।”
এ বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা সুনির্দিষ্ট করে দুর্ঘটনা মুক্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছি। যার জন্য অনেক এলাকায় দুর্ঘটনা হচ্ছে না। এই ড্রাইভারের ব্যাপারটা নিয়ে সমস্যা।
“চালকদের দীর্ঘ সময় যাতে একটানা গাড়ি চালাতে না হয়- এজন্য আমরা বিশ্রাম করার ব্যবস্থা নিচ্ছি। এজন্য অনেকগুলো বিশ্রামাগার তৈরি করা হচ্ছে। এটা হলে চালকরা কিছু স্বস্তি পাবেন।
“আর সবাইকে বলবো আপনারা চালকদের দিয়ে গাড়ি চালান। সে সময়মত খেলো কি না, বিশ্রাম নিতে পারল কী না? অনেকে সেটা করেন না। আপনারা গাড়ি চালাতে বলে দেন। গাড়ি চলতেই থাকে। আপনি পার্টি খেয়ে আসেন, দাওয়াত খেয়ে আসেন, কিন্তু ড্রাইভার খেলো কি না সে খবর রাখে না। সে ব্যাপারে আন্তরিক হবেন।”