তবে বাংলাদেশে ব্যবসায় পরিবেশ নিয়ে উদ্যোক্তাদের মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত এ জরিপে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের চিত্রও এসেছে।
আগে দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল অবকাঠামো বিষয়টিকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করলেও অব্যাহত বিনিয়োগের ফলে এটি এখন শক্তিশালী অবস্থায় চলে এসেছে বলে ব্যবসায়ীরা স্বীকৃতি দিচ্ছেন। আগে তা শীর্ষ থাকলেও এখন চার নম্বরে নেমে এসেছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) পরিচালিত ‘বাংলাদেশে ব্যবসায় পরিবেশ ২০২১’ শীর্ষক উদ্যোক্তা মতামত জরিপের ফলাফলে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বুধবার সিপিডি কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক ও জরিপের পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
স্বাগত বক্তব্যে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত ছোট-বড় ৭৩ জন উদ্যোক্তাদের তথ্য নিয়ে এ মতামত জরিপ পরিচালনা করা হয়। এরমধ্যে ৩৯ জন বড়, ১৭ জন মাঝারি, ১২ জন ছোট এবং ৫ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা সংক্রান্ত তথ্য দেন।
মূলত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম বিশ্বজুড়ে এ জরিপ পরিচালনা করে। গত দুই দশকের মতো এবারও সংস্থাটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশে জরিপটি পরিচালনা করে সিপিডি।
তবে কোভিড-১৯ নতুন করে বিস্তৃতির এ সময়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এ বছর ‘বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা রিপোর্ট ২০২১-২২’ প্রকাশ করছে না। এ প্রেক্ষিতে সংস্থাটির সম্মতিতে সিপিডি এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বলে তিনি জানান।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, “জরিপে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, সুশাসন, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশগত বিষয়গুলো দেখা হয়।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ না করার কারণে র্যাংকিং করার বিষয় নেই। তবে উদ্যোক্তাদের মতামত কী শুধু তাই তুলে ধরা হয়েছে।”
এরপর মূল প্রবন্ধে গোলাম মোয়াজ্জেম গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করে বলেন, জরিপে ১০টি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে অবকাঠামো, প্রতিষ্ঠান, নিরাপত্তা, আর্থিক বিষয়াদি, ব্যবসা বিনিয়োগ, প্রতিযোগিতা, ব্যবসা পরিচালনায় সুশাসন, মানব সম্পদ গড়ে তোলা, কাজের পরিবেশ ও কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও ঝুঁকি।
ড. মোয়াজ্জেম বলেন, “জরিপে সর্বোচ্চ ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন দুর্নীতিই তাদের ব্যবসার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। অদক্ষ প্রশাসনের কথা তুলে ধরে মতামত দিয়েছেন ৬৭ শতাংশ উদ্যোক্তা।“
দেশে ব্যবসা সীমাবদ্ধাতার ক্ষেত্রে সার্বিক বিবেচনায় ব্যবসায়ীরা তিনটি চ্যালেঞ্জে পড়েছেন বলে তিনি তুলে ধরেন। এগুলো হচ্ছে- দুর্নীতি, অদক্ষ প্রশাসন এবং অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা।
অন্যান্য বছরের জরিপের ফলাফলের সঙ্গে এবার কিছুটা পার্থক্য রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “অন্যান্য বছর দুর্নীতি অনেক উপরে থাকত। কিন্তু এবার দেখা গেছে দুর্নীতি এবং অদক্ষ প্রশাসন খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।”
এ তিনটির সঙ্গে ব্যবসায় ব্যয় বেড়ে যাওয়া জড়িত উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এ তিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে একজন ব্যবসায়ীর বাজারে টিকে থাকা এবং বেরিয়ে যাওয়া উভয় ক্ষেত্রেই সমস্যায় পড়ছেন।”
আগে স্বাস্থ্য সেবার মতো যেসব চ্যালেঞ্জ গৌণ ছিল, সেগুলোও এখন উপরে উঠে আসছে। কারণ সুস্বাস্থ্যবান একজন দক্ষ কর্মী এবং তার কাছ থেকে নিরবিচ্ছিন্ন কাজ পাওয়া প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
“করহার এবং কর কাঠামোর জটিলতাও আরেকটি সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন অধিকাংশ ব্যবসায়ী,” যোগ করেন ড. মোয়াজ্জেম।
ব্যবসায়ীরা এবার দক্ষ মানব সম্পদকে উদীয়মান আরেকটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের অর্থনীতি বড় হচ্ছে, গুনগত মানের পরিবর্তন হচ্ছে, বড় বড় বিনিয়োগ আসছে, কিন্তু যে পরিমাণ দক্ষ মানব সম্পদের দরকার তা নেই।”
শীর্ষ ১০ প্রতিবন্ধকতা
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জরিপে ব্যবসার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ১০টি বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী দুর্নীতিকেই সবচেয়ে বেশি সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন।
প্রায় ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ীরা মনে করেন অদক্ষ প্রশাসনের কারণে তারা বাধার মুখে পড়েছেন। প্রায় ৫৫ শতাংশ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, আর্থিক সীমাবদ্ধতা তাদের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। এছাড়া দুর্বল অবকাঠামোর কথা বলেছেন ৪৫ শতাংশ, নীতি সহায়তায় অস্থিতিশীলতা দেখেছেন ৩৬ শতাংশ, স্বাস্থ্য সেবায় সমস্যায় পড়ার কথা বলেছেন প্রায় ৩৫ শতাংশ।
অপরদিকে উচ্চ করহার নিয়ে সমস্যা তুলে ধরেছেন ৩৫ শতাংশ, কর প্রবিধানে জটিলতার কথা বলেছেন প্রায় ৩২ শতাংশ, দক্ষ মানব সম্পদের অভাব বলেছেন প্রায় ২৬ শতাংশ।
এসময় ড. মোয়াজ্জেম বলেন, এসব চ্যলেঞ্জ বা সমস্যা একেক ধরনের ব্যবসায়ীর কাছে একেকভাবে দেখা দিচ্ছে। যেমন দুর্নীতিকে ৫২ শতাংশ বড় ব্যবসায়ী সমস্যা বললেও জরিপে অংশ নেওয়া শতভাগ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিন্তু এটাকে প্রধান চ্যালেঞ্জ বলেছেন।
“আবার ছোট উদ্যোক্তাদের ৮৩ শতাংশ দুর্নীতিকে সমস্যা বলেছেন। একইভাবে সরকারের প্রশাসনে অদক্ষতা এবং সীমিত অর্থায়নের চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রেও বড় ব্যবসায়ীদের তুলনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাছে বহুগুণে বেশি চ্যালেঞ্জিং।“
তিনি বলেন, “দুর্নীতি, প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা একটি বড় ব্যবসায়িক গ্রুপ যেভাবে হ্যান্ডেল করতে পারছে, ক্ষুদ্র বা মাঝারি কোনও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সেভাবে পারছে না।“