বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) যেন জ্বালানি মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সেজন্য আইন সংস্কারের দাবি জানিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
Published : 02 Dec 2021, 10:56 PM
বৃহস্পতিবার ‘ভোক্তার জ্বালানি অধিকার সংরক্ষণে বিইআরসি আইন ও বিইআরসির ভূমিকা মূল্যায়ন’ শীর্ষক বৈঠকে এই দাবি জানানো হয়।
বৈঠকে মূল আলোচক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, বিইআরসি বা বার্কের ২০০৩ সালের আইনে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে, তা বার্ক ঠিকভাবে প্রয়োগ করছে না। দ্বিতীয়ত সরকার এখানে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বার্কের ক্ষমতা খর্ব করছে।
বার্কে লোক নিয়োগের যোগ্যতা অযোগ্যতাগুলো নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ভোক্তা স্বার্থ রক্ষার সুপারিশ করেন তিনি।
ক্যাবের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, পেট্রোল-ডিজেলের দাম নির্ধারণের বিষয়টি শুরুতে বিইআরসির অধীনে থাকলেও পরে সেটা মন্ত্রণালয়ে চাপ দিয়ে সরিয়ে নিয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত ব্যক্তি যাতে নিয়োগ পান, সেজন্য আইনের সংস্কারের কথা বলেন তিনি।
সাবেক এই আমলা বলেন, অবসরে যাওয়ার পর পুরোদস্তুর এক ঘণ্টার ইন্টারভিউ দিয়ে তিনি ৩৮ জন প্রতিযোগীর ভেতর থেকে বিইআরসির প্রথম চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য হয়েছিলেন। কিন্তু তাকে নিয়োগ না দিয়ে আরেকজনকে তখন নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পরে তত্ত্ববধায়ক সরকারের সময়ে আগের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করে চলে যাওয়ার কারণে তাকে ডেকে নিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
“সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া যে পদ্ধতিতে ছিল সেটা যদি এখনও অনুসরণ করা হত এতো প্রশ্ন উঠত না।”
বর্তমান কমিশনের দুর্বলতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এই কমিশনের প্রশাসনিক ক্ষমতা রয়ে গেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের হাতে। এটা যতদিন থাকবে ততদিন কাজ করা কঠিন হবে। বিইআরসি এখন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সাতপাকে বাঁধা। এখানে অনেক স্বার্থের দ্বন্দ্ব (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট আছে)। মন্ত্রণালয় থেকে অবসরে গিয়ে তাদের কেউ কেউ বিইআরসির চেয়ারম্যান, মেম্বার হচ্ছেন। স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার জন্য আমাদের এটা বন্ধ করা দরকার।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, “বিইআরসিকে গণশুনানির মতো একটা সুযোগ ভোক্তাদের জন্য দেওয়া হয়েছিল, সেটাও সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কোর্ট বলে দিলে পরে বার্ক গণশুনানি করে।
“বাংলাদেশে ক্ষমতা ভোক্তাদের হাতে নেই; আছে ব্যবসায়ীদের হাতে, অসৎ আমলাদের হাতে এবং অসৎ রাজনীতিবিদদের হাতে।”
বিইআরসি যতদিন সরকারের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে কাজ করতে না পারবে, ততদিনে ভোক্তার অধিকার রক্ষা হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, “জ্বালানি খাতের অধিকাংশ কোম্পানি সরকারি এবং সেখানে সর্বত্র কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের চর্চা হয়।
“বার্ককে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সচিবরা বলে বেড়াচ্ছে যে বার্কের দরকারটা কী? আমাদের কর্মচারীরা শীর্ষপদে উঠি কী সব বলছে! তারা প্রস্তাব দিচ্ছে বার্ককে ক্ষমতাহীন করার জন্য। বার্কের যে ক্ষমতা আছে সেটাও চর্চা করতে দিচ্ছে না।”
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, “আমরা বিইআরসিকে শক্তিশালী করার আলোচনা করছি। অথচ বিইআরসি থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি যে তেলের দাম বাড়ানো হলে, তার আগে কারও মতামত নেওয়া হয়নি।
“কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বিশেষভাবে প্রযোজ্য আমাদের আমলাদের মধ্যে। তারা সরকারের ভেতরে আরেকটা সরকার। বিচারকরা তো ব্যবসা করতে পারে না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হতে পারেন না। উনারা সরকারি কর্মকর্তা হয়েও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হচ্ছেন। মিটিংয়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য টাকা, চেয়ারম্যান হিসাবে অনারিয়াম বাবদ টাকা। গাড়ি মেইনটেইন করার জন্য টাকা …এসব কিছু নিয়ন্ত্রণের জন্য বিইআরসিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।”
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এনার্জিপ্যাকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশীদ বলেন, “এলপিজি কোম্পানি করার জন্য ২৮টি লাইসেন্স নিতে হয়েছে ২৮টি অধিদপ্তর থেকে। বিইআরসি কী আসলেই রেগুলেটরি বডি? নাকি বিস্ফোরক পরিদপ্তর রেগুলেটরি বডি নাকি মোংলা পোর্ট রেগুলেটরি বডি, আমরা ঠিক বুঝতে পারি না।
“বিপিসির নিজেই এলপিজি নিয়ে ব্যবসা করে। সেও আমাকে রেগুলেট করে। এটা তো হতে পারেনা। বার্ককে পুরোপুরি প্রায়োগিক করতে হলে আমলাতন্ত্র থেকে বের করে আনতে হবে।”
বাংলাদেশ এলপিজি অটোগ্যাস স্টেশন মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ সিরাজুল মওলা বলেন, “যখন এলপিজি স্টেশন চালু হয়ে কেউ ৪০ টাকা কেউ ৩৫ টাকা প্রতি লিটার এলপিজি বিক্রি করত। কোনো নির্ধারিত মূল্য ছিল না। ক্যাবের উদ্যোগে একটা দাম নির্ধারণ করা গেল। কিন্তু এই দাম কেউ মানছে না।”
মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশেনর সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমাদের অফিসিয়াল ব্যাপারগুলো সহজ করে বিইআরসির সক্ষমতা বাড়িয়ে এখানে সৎ ব্যবসাকে উৎপাহিত করতে হবে।”