লকডাউন: উদ্বিগ্ন পোশাক শিল্প মালিকদের বিকল্প প্রস্তাব

করোনাভাইরাস মহামারীর দেড় বছর পেরোতে চললেও বিধি-নিষেধের কোনো পর্যায়ে কারখানা বন্ধ রাখতে হয়নি। কিন্তু এবার সংক্রমণের ভয়াবহতম পরিস্থিতির কারণে কারখানা বন্ধ রাখতে হওয়ায় ভরা মৌসুমে রপ্তানির পণ্য যথাসময়ে পাঠাতে পারা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 July 2021, 02:39 AM
Updated : 27 July 2021, 02:39 AM

তারা বলছেন, গত বছরের শুরু থেকে চলা মহামারীর কারণে বৈশ্বিক চাহিদা কমায় ক্রয় আদেশের দীর্ঘদিনের খরা কাটিয়ে কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছিল দেশের রপ্তানিমুখী প্রধান খাত। সংক্রমণ পরিস্থিতি যদি আরও খারাপ হয় এবং ৫ অগাস্টের পরও কারখানা বন্ধ রাখতে হয়, তাহলে তারা বড় ক্ষতির মুখে পড়বেন।

সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে তৈরি পোশাক কারখানার কর্মীদের গণটিকাদানের পাশাপাশি শেষ পর্যায়ে থাকা ক্রয় আদেশের কাজগুলো সারতে সীমিত সংখ্যক শ্রমিক দিয়ে কারখানা খোলার প্রস্তাব রেখেছেন মালিকরা।

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহ সভাপতি শহিদুল আজিম সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জুন, জুলাই ও অগাস্ট মাস হচ্ছে পোশাক রপ্তানির ‘পিক টাইম’। সারা বছরের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ রপ্তানি হয় এই সময়ে।

“পশ্চিমের দেশগুলোতে ক্রিসমাস ও উইন্টার সিজনের অর্ডারগুলো এখন শিপমেন্টের পর্যায়ে রয়েছে। তাই এই পরিস্থিতিতে পণ্য দিতে না পারলে তারা বিলম্বে এই পণ্যগুলো নিয়ে বিক্রি করতে পারবে না।”

যথাসময়ে জাহাজে পণ্য পাঠাতে না পারলে পরে কার্গো বিমানে পাঠাতে পরিবহন ব্যয় ৩/৪ গুণ বেড়ে যাওয়ার কথাও বলেন তিনি।

“এসব নিয়ে আমরা ঝামেলার শঙ্কায় আছি। বেতন দিতে হবে, ব্যাংক ঋণ দিতে হবে ইত্যাদি।”

মহামারীর মধ্যে ঢাকার একটি পোশাক কারখানার প্রবেশপথে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিচ্ছেন কর্মীরা। ফাইল ছবি: মাহমুদ জামান অভি

২০২০ সালের মার্চে প্রথম দফায় লকডাউন ঘোষণার সময়ও পোশাক কারখানাগুলো শতভাগ বন্ধ করতে হয়নি। এবার পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ ধারণ করায় ৫ অগাস্ট পর্যন্ত ১৪ দিনের যে লকডাউন চলছে, তাতে সব কারখানাও এর আওতায় রাখা হয়েছে।

ঈদের আগে কারখানা খোলার দেন দরবার চালালেও এখন পরিস্থিতি দেখে অনেক শিল্প মালিক কারখানা খুলতে এখনই চান না।

ঈদের পর কোভিড-১৯ মহামারীতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সোমবার রেকর্ড সংখ্যক ১৫ হাজার ১৯২ জনের দেহে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আর আক্রান্তদের মধ্যে একদিনে সর্বাধিক ২৪৭ জনের প্রাণ গেছে।

বিজিএমইএ সহসভাপতি আজিম বলেন, “যেভাবে ইনফেকশন রেট বাড়ছে, এখন কারখানা খোলার বিষয়ে কিচ্ছু করার নেই। আমরা ভাবছিলাম, সংক্রমণ কমে আসবে। এখন উল্টো আরও বাড়ছে। সব ফ্যাক্টরি বন্ধ, আমরা সরকারের সিদ্ধান্ত মেনেই চলব।”

তার ভাষ্য, মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর আগে পোশাক খাত ভালো রকমে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও এখন আর সেই অবস্থায় থাকছে না।

“মহামারীর আগে ৩৪ বিলিয়ন রপ্তানি হয়েছিল। পরে সেটা ৬ বিলিয়ন কমে গেল। এরই মধ্যে আমরা ৩ বিলিয়ন ডলার রিকভারি করলাম। ভাবছিলাম আরও বাড়বে। কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে সেটা ভাবা যাচ্ছে না।”

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেও সদ্য সমাপ্ত ২০২০-২০২১ অর্থবছরের রপ্তানি আয়ে আগের চেয়ে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অধিকাংশ আসে পোশাক রপ্তানি থেকে। ফাইল ছবি

গত ৩০ জুন শেষ হওয়া অর্থবছরে মোট ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের (৩৮ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন) পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। মোট রপ্তানি আয়ের ৮১ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে।

ঈদের আগে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে পোশাক শিল্প খাতকে লকডাউনের আওতামুক্ত রাখার সুপারিশ করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। তবে বর্তমান পরিস্থিতি দেখে সোমবারও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। 

এই পরিস্থিতিতে একাধিক রপ্তানিকারক বললেন, কারখানাগুলোর সাপ্লাই চেইনে এমন অনেক অর্ডারও রয়েছে যেগুলোর প্রায় ৯০ শতাশ কাজ হয়ে গেছে; শুধু ফিনিশিং বা কার্টনিং বা প্যাকেজিং করলেই শিপমেন্ট দেওয়া সম্ভব। লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে স্বল্প সংখ্যক শ্রমিক দিয়ে এই কাজগুলো সম্পূর্ণ করার কথা ভাবতে হবে।

বিজিএমএইর সিনিয়র সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের পোশাক ব্যবসায়ী সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সরকারের কাছে বলেছি, যেসব অর্ডারের কাজ প্রায় চূড়ান্ত সেগুলো শেষ করার জন্য একেবারেই ক্ষুদ্র পরিসরে ৫০/৬০ জন মানুষ দিয়ে কাজগুলো রপ্তানি উপযোগী করার ব্যবস্থা করা হোক। আমরা এটা নিয়ে গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করছি। আশা করি, একটা কিছু হবে।”

এবিষয়ে পুলিশ প্রশাসনসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে বলে জানান বিজিএমইএ সহ-সভাপতি আজিম।

‘কঠোর’ লকডাউনে ফাঁকা রাজধানীর বাণিজ্যিক কেন্দ্র মতিঝিল। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

ক্রয়াদেশ পূরণে কাজের প্রচণ্ড চাপ থাকায় কারখানা খুলে দেওয়ার জোরালো দাবি রয়েছে বলে জানান নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।

তিনি সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজকে একজন কারখানা মালিক ফোন করে জানালেন, ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে তার শিপমেন্ট দেওয়ার কথা ছিল। এই সময়ের মধ্যে দিতে না পারলে অর্ডার বাতিল করার হুমকি দিচ্ছেন ক্রেতা। অথচ তার কাজের ৮০ শতাংশই কমপ্লিট।”

রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস কারখানাগুলো ১ অগাস্ট থেকে খুলে দেওয়ার একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে বলে হাতেম জানান।

বিকেএমইএর সহ সভাপতি বলেন, তবে সব কারখানা একসঙ্গে খোলা যাবে না। তাতে সংক্রমণ বাড়ার ঝুঁকি বেশি থাকবে।

“আমরা চাচ্ছি, রপ্তানিমুখী কারখানাগুলো ধাপে ধাপে খুলে দেওয়া হোক। কিন্তু আমাদের ভাবনায় তো আর কাজ হচ্ছে না। সরকার যা ভাববেন সেটাই হবে।”

এই সঙ্কট থেকে উত্তরণে টিকার উপর জোর দিয়ে বিজিএমইএর সহ সভাপতি শহিদুল আজিম বলেন, “সবচেয়ে বড় সমাধান হচ্ছে টিকা। টিকা না দিতে পারলে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।”

রপ্তানিমুখী পোশাক খাত সচল রাখতে শ্রমিকদের গণটিকাদানকে একমাত্র সমাধান মনে করেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আখতারও।

লকডাউনে কারখানা বন্ধ রাখার কারণে শ্রমিকদের বেতনের ওপর যাতে কোনো প্রভাব না পড়ে সে বিষয়ে সতর্ক করেন এই শ্রমিক নেতা।

বাবুল বলেন, “দুশ্চিন্তার কারণ আছে। মালিকরা সব সময় ঠকাতে চায়। যেহেতু সরকারের নির্দেশে মালিকরা কারখানা বন্ধ রেখেছে। তাই এই ছুতায় শ্রমিকের বেতন কম দিতে চাইলে সেটা হবে দুঃখজনক। এটা নিয়ে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।

“তবে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকলেও তাতে বেতনের উপর প্রভাব পড়ার কথা নয়। কারণ অনেক ফ্যাক্টরিতে এমনিতেই ২৮/৩০ জুলাই পর্যন্ত ঈদের ছুটি রয়েছে। ছুটির আগে শ্রমিকরা টানা কাজ করে বাড়িতে গেছে। তাই আপাতত শ্রমিকের বেতন নিয়ে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”