দেশে ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে জ্বালানি আমদানির বিকল্প ছিল না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই এলাহী বলেছেন, সরকার আমদানির পাশাপাশি দেশীয় উৎসগুলোও কাজে লাগাতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
Published : 09 Aug 2020, 06:41 PM
রোববার ঢাকায় এক ভার্চুয়াল আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, “পরিবর্তনশীল বিশ্বে খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজগুলো করতে হয়। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুব দূরদর্শীতার সঙ্গে পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখে কাজগুলো করে যাচ্ছেন। জ্বালানি খাত তারই একটি উদাহরণ।”
তিনি বলেন, “২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর একদিকে নতুন নতুন শিল্পায়ন শুরু হয়, অন্যদিকে মজুদ গ্যাসের অপর্যাপ্ততা দেখায় দেয়। এই পরিস্থিতিতে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণ করে এলএনজি আমদানির পথ সুগম করেন। বর্তমান চাহিদার আলোকে দেশীয় জোগানের পাশাপাশি এই এলএনজি এখন জ্বালানির অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উৎস।
“পাশাপাশি দেশীয় খনি থেকে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজও এগিয়ে চলছে। স্থলভাগের গ্যাস নিয়ে অন্যদের মতো আমিও বেশ আশাবাদী। কারণ মানসম্পন্ন ও সুলভ জ্বালানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে জ্বালানির বৈচিত্র্যের বিকল্প নেই।”
জ্বালানি আমদানির পেছনে যুক্তি তুলে ধরে উপদেষ্টা বলেন, “এখন আমাদের হাতে আছে কেবল গভীর সমুদ্রের গ্যাস। কিন্তু আজকে আবিষ্কার হলেও তা কাজে লাগাতে আরও অন্তত ১০ বছর সময় লেগে যাবে। সুতরাং কোনো কিছুর অপেক্ষায় বসে থাকলে চাহিদার জোগান দেওয়া সম্ভব হবে না। একাধিক বিকল্প নিয়েই এগোতে হবে। পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে।”
আলোচনায় অংশ নিয়ে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, “বর্তমানে ২৭টি কূপ থেকে সর্বোচ্চ ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকা চাহিদার বিপরীতে নিরবচ্ছিন্ন ও এফর্ডেবল জ্বালানি নিশ্চিত করতে আমদানির দিকে যেতে হয়েছে। বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যেও গ্যাসের চাহিদা কমেনি। ফলে বোঝা যায় শিল্পগুলো তাদের উৎপাদনে ফিরে আসতে পেরেছে।”
জ্বালানি খাতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, “এই খাতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এখানে পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে অহরহ। সবদিক বিবেচনা করেই আমরা মিক্স ফুয়েলের দিকে গিয়েছি, যাতে কোনো একটি উৎসে সমস্যা হলেও তাতে সবকিছু থমকে না যায়।”
জ্বালানি খাতের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বেশ কয়েকটি অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন প্রতিমন্ত্রী।
“মিয়ানমার থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ হয়ে ভারতে গ্যাস পাঠানোর প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার পাকিস্তানের পরামর্শে সেই প্রস্তাবটি অগ্রাহ্য করেছিল। ওই এক সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশ জ্বালানি খাতে ২০/২৫ বছর পিছিয়ে গেছে। তাদের এরকম আরও কিছু অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে এখন বাংলাদেশ সাফার করছে।”
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড- আরপিজিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুজ্জমান।
দেশের সমুদ্র ব্লকে জ্বালানি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও স্থলভাগে নতুন গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম বলে প্রবন্ধে উল্লেখ করেন এই প্রকৌশলী। তবে তার ওই বক্তব্যের বিরোধীতা আসে স্বয়ং উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী ও অন্যান্য আলোচকদের কাছ থেকে।
কামরুজ্জামান বলেন, “বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ। এখানে ফুটো করতে করতে একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। অনশোরে নতুন করে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। পুরোনো ও পরিত্যক্ত গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে এখন চেষ্টা করা হচ্ছে।
“২০১০ সালে গ্যাস থেকে ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ উপাদন হলেও সেটাকে কমিয়ে আনা হচ্ছে। ২০৩০ সালে সেটা ৪৫ শতাংশে নেমে আসবে এবং ২০৪১ সালে সেটা ৩৫ শতাংশে নেমে আসবে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে আনা হবে।”
বর্তমান বিশ্ববাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় এলএনজি আমদানি বাড়ানো যেতে পারে বলেও মত এই বিশেষজ্ঞের।
“এলএনজিকে একটি সুযোগ হিসাবে দেখা যেতে পারে। এখন ৬৫০ এমএমসিএফডি আমদানি করা হচ্ছে। এটা বাড়াতে হবে। এই মুহূর্তে এলএনজির দাম খুবই কম। তাই স্টোরেজ ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। যেহেতু দাম কম তাই এলএনজি আমদানি বাড়িয়ে দেশীয় উৎপাদন কমিয়ে দেশের গ্যাসের লাইফ বাড়াতে হবে।”
অবশ্য প্রবন্ধে বিশ্ববাজারে এলএনজির দরপতনের সঠিক কোনো তথ্য উল্লেখ করেননি তিনি।
ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছে এমন দাবির বিরোধীতা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া বলেন, সারা বাংলাদেশে যে পরিমাণ ড্রিলিং করা হয়েছে, অনেক সময় একটি খনিতেও এর চেয়ে বেশি ড্রিলিং হয়ে থাকে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, “স্থলভাগে সম্ভাবনা খুব একটা নেই, সে ব্যাপারে আমারও দ্বিমত রয়েছে। অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে সম্ভাবনা রয়েছে।”
ফোরাম অব এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশের সভাপতি অরুণ কর্মকার বলেন, “গত ১০ বছরে ৯ টিসিএফ গ্যাস কনজাম্পশন হলেও আবিষ্কার হয়েছে মাত্র এক টিসিএফ। অন্যান্য খাতে উন্নয়ন হলেও জ্বালানি খাতে তেমনটা হয়নি। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি আমদানি হচ্ছে, যা অব্যাহত থাকলে একসময় এমন আমদানির চাপ সহ্য করা কঠিন হবে।”
ভূমিতে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলে যে দাবি মূল প্রবন্ধে করা হয়েছে তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তিনি বলেন, “কোনো রকম সার্ভে করার আগে এমন দাবি করা যায়না। আমাদের প্রয়োজন হচ্ছে রিসোর্স অ্যাসেসমেন্ট করা।
“এখন পর্যন্ত সুরমা বেসিন থেকে গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে। বেঙ্গল বেসিন ভোলা ছাড়া অন্যান্য এলাকাগুরো আনটাচ রয়ে গেছে। প্রকৌশলীরা মনে করে বেঙ্গল বেসিনও অনেক সম্ভাবনাময়। সুরমা বেসিনেরও কিছু এলাকা এখন রয়ে গেছে।”
‘এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার’ সম্পাদক মোল্লাহ আমজাদ হোসেন বলেন, নিজস্ব জ্বালানিকে অলস রেখে শুধু আমদানির দিকে ঝুঁকলে জিও পলিটিক্সের কারণে সংকট তৈরি হতে পারে।
জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত এই সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন জ্বালানি বিভাগের সচিব আনিছুর রহমান।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান শহীদুজ্জামান সরকার, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান এবিএম আব্দুল ফাত্তাহ, বিপিসির চেয়ারম্যান সামছুর রহমান, সাংবাদিক আরিফুজ্জামান তুহিন, মাহফুজ মিশু, শাহনাজ বেগম আলোচনায় অংশ নেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সাল থেকে ৯ অগাস্ট জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর এই বছর ঘটা করে দিনটি পালনের পরিকল্পনা থাকলেও কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে তা ওয়েবিনারেই সীমাবদ্ধ রাখতে হয়েছে।