এজন্য এ খাতের বরাদ্দ বাড়ানোসহ নতুন বাজেটে একটি ‘মেগা প্ল্যান’ ঘোষণা করা হবে। এর মধ্যে থাকবে ৩ বছরের মধ্যম এবং ১০ বছরের দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা।
এই দুই মেয়াদের পরিকল্পনায় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটবে বলে আশাবাদী মুস্তফা কামাল।
জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের দুদিন আগে মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বাস্থ্য খাতের দুর্দশার বিষয়টি স্বীকার করে তা ঢেলে সাজানোর কথা বলেন তিনি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, “এ কথা বলার অবকাশ নেই যে, আমাদের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল অবস্থা। এ অবস্থা আমরা আর রাখতে চাই না।
“বিদ্যুৎ খাতের মতো স্বাস্থ্য খাতে ১০ বছরের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতেই মেগা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে যাচ্ছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এই ‘মেগা প্ল্যান’ নিচ্ছি।
“একসময় দেশে বিদ্যুতের খুবই সঙ্কট ছিল। এখন আমরা বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যেভাবে আমরা বিদ্যুৎ খাতের সফলতা অর্জন করেছি। স্বাস্থ্য খাতেও দেখিয়ে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ।”
করোনাভাইরাস মহামারী দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দৈন্য ফুটিয়ে তুলেছে। মেডিকেল টেকনোলজিস্টের অভাবে রোগীর নমুনা সংগ্রহ যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে, তেমনি আক্রান্তদের সেবা দিতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্সের অপ্রতুলতার প্রকাশও ঘটেছে। সেজন্য তড়িঘড়ি করে নিয়োগ দিতে হয়েছে সরকারকে।
বিভিন্ন হাসপাতালে আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) স্বল্পতার বিষয়ও প্রকাশ্য হয়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সক্ষমতার ঘাটতিও নজরে এসেছে।
সেই অবহেলার গর্ত থেকে এ স্বাস্থ্য খাতকে তুলে আনতে নতুন বাজেটে ‘মেগা প্ল্যান’ ঘোষণা করা হচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, স্বাস্থ্য খাতে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে থাকছে জনবল নিয়োগ। প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্সসহ এ খাতে ঘাটতি পূরণ।
এই পরিকল্পনায় উন্নত বিশ্ব থেকে বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষক এনে দেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ানদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হবে। ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ থেকে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ আনা হবে। তাদের মাধ্যমে দেশে গড়ে তোলা হবে দক্ষ জনবল। স্বাস্থ্য খাতে গবেষণা আরও বাড়ানো হবে।
বিনিয়োগ বাড়ানো হবে অবকাঠামো খাতে। নতুন হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। প্রত্যেক জেলায় গড়ে তোলা হবে গবেষণাগার। এছাড়া মেডিকেল সরঞ্জাম কেনাকাটা করা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য ২৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২৩.৪৪ শতাংশ বেশি।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন-অনুন্নয়ন মিলে ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে সংশোধনে তা কমে ২৩ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা হচ্ছে।
করোনা মোকাবেলায় কর্মরত সরকারি চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হলে তাদের পদ অনুযায়ী আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে নতুন বাজেটে ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতার জন্য এরই মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) এগিয়ে এসেছে। এরই মধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ১ হাজার ১২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
এডিবির অর্থায়নে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায়। এআইআই ব্যাংকের অর্থায়নে আরেকটি প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে। আর দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থায়নে আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালের জন্য ভেন্টিলেটর কেনা হবে।
বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, এআইআই ব্যাংকের ঋণের টাকায় হাসপাতালগুলোয় আইসিউ স্থাপন করা হবে। আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করা হবে। স্থলবন্দর, বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন স্থানে ৪৩টি স্ক্যানার মেশিন বসানো হবে।
আইইডিসিআরের জন্য ল্যাব সংখ্যা বাড়ানো, যানবাহন বাড়ানো, দেশের বিভাগীয় শহরে আইইডিসিআরের অফিস স্থাপন করা হবে। এই চারটি প্রকল্প বাস্তবায়নে বাজেটে আড়াই হাজার কোটি টাকা রাখা হচ্ছে।
চীনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এআইআই ব্যাংক দুই ধাপে ২০ কোটি ডলার ঋণ দেবে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
“এভাবেই আমরা স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাব,” বলেন অর্থমন্ত্রী।
তবে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয়ের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা অর্জনে গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি।
মুস্তফা কামাল বলেন, “অনেকে বলছেন উন্নয়ন বাজেটের টাকা কম ব্যয় করে স্বাস্থ্য খাতে ব্যবহার করতে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যয় করার সক্ষমতা কতটুকু। এ মন্ত্রণালয় বছরে ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে পারে না। কিন্তু তাদের সেখানে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলে কোনো লাভ হবে না। এজন্য ব্যয়ের সক্ষমতা আগে বাড়াতে হবে।”
নিজের দ্বিতীয় বাজেট দেশের বড় সঙ্কটকালে দিতে যাচ্ছেন মুস্তফা কামাল; এমন পরিস্থিতিতে দেশ কখনও পড়েনি।
এবারের বাজেটের প্রধান লক্ষ্য কী- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “দেখতেই পারছেন কোভিড-১৯ সবকিছু ওলটপালট-তছনছ করে দিচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বই আজ গভীর সঙ্কটে। এই সঙ্কট মোকাবেলা করা চ্যালেঞ্জিং। আর সেই কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাই হবে এবারের বাজেটের প্রধান লক্ষ্য।
“এই কঠিন সময়ে দেশের মানুষকে খাবার দিতে হবে। তাদের নিত্যদিনের জন্য যে সমস্ত জিনিস প্রয়োজন, তা দিতে হবে। গ্রামে-গঞ্জে মানুষকে কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে। কৃষি খাতের উৎপাদন আরও বাড়াতে এ খাতকে সমৃদ্ধ করতে হবে।”
“মোট কথা দেশের জনগোষ্ঠীই হচ্ছে আমার এবারের বাজেটের অগ্রাধিকার। এই হল বাজেটের মূল কথা,” বলেন তিনি।
বৈশ্বিক মহামারীতে দেশের রপ্তানি তলানিতে ঠেকায় এই পরিস্থিতিতে কৃষির উপর জোর দেওয়ার কথাও বলেন অর্থমন্ত্রী।
“আমাদের অর্থনীতির প্রাণ হচ্ছে কৃষি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘এক ইঞ্চি আবাদী জমিও অনাবাদী থাকবে না’ ঘোষণার বাস্তব প্রতিফলন পাওয়া যাবে এবারের বাজেটে। কৃষি হবে শতভাগ যান্ত্রিক কৃষি। অনেক তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার হবে কৃষি খাতে। আর এজন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হবে।”
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, কোভিড-১৯ কৃষি খাতেও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে ফেলছে। ফলে কৃষকদের টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি থাকছে নতুন বাজেটে। কারণ কৃষককে টিকিয়ে রাখতে পারলে খাদ্য নিয়ে সমস্যা হবে না।
এজন্য নতুন বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে ২ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। এ খাতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ২৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৭ হাজার ২৩ কোটি টাকা।
সেটা কীভাবে দেওয়া হবে-এ প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমরা সারা বছর ধরে কিন্তু বয়স্ক, বিধবাসহ বিভিন্ন ভাতা এবং বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে অসহায়-গরিব মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করে থাকি। এই কঠিন পরিস্থিতিতে নতুন বাজেটে এ সব কর্মসূচির সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হবে।”
করোনাভাইরাস সঙ্কট প্রায় তিন কোটি নিম্ন আয়ের মানুষের রুটি-রুজিতে আঘাত করেছে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। নতুন বাজেটে এ খাতে ব্যয় করা হবে ৩২ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, “সঙ্কটের এই সময়ে গরিব মানুষকে খাবার দিতে হবে। যে করেই হোক দিতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। আমরা দিয়ে যাচ্ছি। নতুন বাজেটেও তা অব্যাহত থাকবে। সে জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর পাশপাশি বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বরাদ্দ বাড়ছে ১ হাজার ১৬ কোটি টাকা।
বাজেটের আকার কেমন হবে- এ প্রশ্নের উত্তরে মুস্তফা কামাল বলেন, “বাজেটের আকার বড় কথা নয়; আসল কথা হচ্ছে কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলা করা; সঙ্কটে নিমজ্জিত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা। সেটির যথাযথ প্রতিফলনই থাকবে বাজেটে।”