‘উদ্যমহীন’ সরকারের প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে সন্দেহ সিপিডির

টানা তৃতীয় মেয়াদে গঠিত আওয়ামী লীগের সরকারের ১০০ দিনের কাজ দেখে একে ‘উদ্যমহীন’ বলেছে সিপিডি; এই সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে হিসাব দেখাচ্ছে, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2019, 02:03 PM
Updated : 23 April 2019, 02:05 PM

শেখ হাসিনার নতুন সরকারের প্রথম ১০০ দিনের কাজের মূল্যায়ন নিয়ে মঙ্গলবার ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে এক আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করে সিপিডি।

বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো দল টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করল। গত জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়া এই সরকার চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ হবে বলে ধরেছে।

সরকারের এই প্রাক্কলনের কাছাকাছি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের আভাস দিয়েছে এডিবি; তারা বলছে এই অঙ্ক ৮ শতাংশ হতে পারে। তবে বিশ্ব ব্যাংক বলছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, “৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে কোনো গ্লানি, পরিতাপ বা হিংসা নই, আমরাও ৮ শতাংশ চাই।

“কিন্তু এই ৮ শতাংশ ডিজিটটা যেন ঠিকমতো অনুমিত হয়, যাতে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বা যারা মূল্যায়ন করি, তারা যেন সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি।”

দেবপ্রিয়র ভাষ্য, বিভিন্ন খাতের যে অবদান থাকার কথা, সেটা দেখা যাচ্ছে না, অথচ উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে।

তিনি বলেন, “এই প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়ন হলে যে ধরনের কর আহরণ হয়, সেই কর আহরণ আমরা দেখলাম না। ব্যক্তি খাতে যে ধরনের ঋণ প্রবাহ বাড়ার কথা, সেটাও দেখলাম না।

“ব্যাংকিং খাতে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে যে ধরনের চাঞ্চল্য থাকে, তাও দেখলাম না। বড় পুঁজিপণ্যের আমদানির প্রবৃদ্ধির হার গতবারের তুলনায় কমে গেছে।”

“তাহলে প্রবৃদ্ধির সাথে যে সমস্ত চলক থাকে, সে চলকগুলোর ক্ষেত্রে যে ধরনের প্রতিফলন হওয়ার কথা, সেগুলো কিন্তু আমাদের কাছে ধরা পড়ছে না,“ বলেন তিনি।

দেবপ্রিয় বলেন, যে প্রবৃদ্ধিটা হয়েছে সেটা সঠিক ধরে নিলেও বিনিয়োগ যেহেতু বেশি হয়নি, সেহেতু শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেশি হতে হবে।

“কিন্তু গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে এমনকি প্রযুক্তি বা উদ্ভাবন যুক্ত বা রূপান্তর ঘটল যে আমার শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৈপ্লবিকভাবে বেড়ে গেলো।

“শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়লে শ্রমিকের আয় বাড়ার কথা। কিন্তু সরকারের খানা জরিপসহ তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, বৈষম্য বাড়ছে। যে ধরনের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তা ব্যাখ্যা করতে হলে তাতে আয় ও কর্মসংস্থানের যে চিত্রটি আসে, তাও স্বস্তিদায়ক হচ্ছে না।”

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, “বিবিএস এর পক্ষ থেকে জিডিপি‘র যে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। ম্যানুফাকচারিং খাতের ওপর ভর করে প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হলেও দেখা গেছে চামড়া শিল্পের প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশ কমে গেছে।

“বেসরকারি বিনিয়োগ তেমন না বাড়লেও সরকারি বিনিয়োগের বিনিয়োগের উপর ভর করে প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে। কিন্তু ২০১০ থেকে ১৭ পর্য়ন্ত তার আগের দশ বছরের তুলনায় কর্মসংস্থান উল্টো ৪ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হারাচ্ছে।”

মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির এই হিসাব কীভাবে নিরূপণ হল, তা প্রকাশের দাবি জানিয়েছে সিপিডি।

দেবপ্রিয় বলেন, “যে সমস্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিকে প্রবৃদ্ধি অনুমিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা হোক। আমরা ফুল ডিসক্লোজার চাচ্ছি।

“এটার উপর জোর দেওয়ার কারণ হচ্ছে, আমরা চাই প্রবৃদ্ধির অনুমিতিটা সঠিক হোক, যেন বাংলাদেশের আগামী দিনের নীতিকে সঠিকভাবে আলোকিত পথে পরিচালিত করতে পারে। এটাই হচ্ছে আমাদের আকাঙ্ক্ষা।”

এই প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় বলেন, “এই প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে কেউ আমার কাছে প্রশ্ন করতে পারেন, কিন্তু আমি উত্তর দিতে পারব না। এর উত্তর সরকারের কাছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে এবং বিবিএস, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিনিয়োগ বোর্ডের কাছে রয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, সরকারের মধ্যে প্রবৃদ্ধি নিয়ে এক ধরনের আচ্ছন্নতা আছে। কিন্তু এখন উন্নয়নের ক্ষেত্রে উচ্চ প্রবৃদ্ধিই প্রধান নিয়ামক নয়।

“সাম্প্রতিককালে অর্থনীতির তাত্ত্বিকরা স্বীকার করেছেন, প্রবৃদ্ধিটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু যথেষ্ট নয়। মানব উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়েছে, জনগণের জীবন মানের বিভিন্ন সূচকের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।”

“ব্যাংক, শেয়ারবাজারসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ না আসলে এই প্রবৃদ্ধি কি উপকারে আসছে,” বলেন দেবপ্রিয়।

এই অনুষ্ঠানে সিপিডির আরেক সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বক্তব্য রাখেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

এই নির্বাচনের আগে দেওয়া আওয়ামী লীগের ইশতেহারকে সবচেয়ে ‘সুচিন্তিত’ বললেও সরকারের প্রথম ১০০ তিনের কার্যক্রমে হতাশা প্রকাশ করেন দেবপ্রিয়।

তিনি বলেন, “একটি উৎসাহহীন, উদ্যোগহীন, উচ্ছ্বাসহীন এবং উদ্যমহীন একশ দিন দেখেছি। অথচ আমরা আশা করেছিলাম, একটি বড় ধরনের উত্থানের ১০০ দিন হবে, সেটা আমরা লক্ষ্য করিনি।”

সরকারের যে ধরনের উদ্যোগ গত ১০০ দিনে দেখেছেন, তা ‘মিশ্র ইঙ্গিত’ দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“যেমন আমরা লক্ষ্য করেছি কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সুদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। মনে হয় সরকারকে একটি পতিত গোষ্ঠী যেন করায়ত্ত করে নীতি নির্ধারণ করছে। উন্নয়নের যে ধারণা, তার সঙ্গে নীতি নির্ধারণের এ ধারণার ভিতরে অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।”

জনপ্রতিনিধিদের যে ভূমিকা থাকার কথা, তাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

দেবপ্রিয় বলেন, “দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য কাঠামোগত যে সংস্কারের দরকার ছিল, সেগুলোর কিছুই হয়নি। আমরা আশা করেছিলাম এ ধরনের অসঙ্গতিগুলো দূর করতে উদ্যোগী হবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে আমরা সচেতনতাও দেখিনি, পদক্ষেপও দেখিনি।”

গত বছরগুলোতে সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থিতিশীলতা থাকলেও সামনে মূল্যস্ফীতির সঙ্কট দেখছে সিপিডি।

দেবপ্রিয় বলেন, “আগামী দিনে টাকার বিনিময় হারের ক্ষেত্রে যে ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে, তার ফলে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির কী অবস্থা হবে? বৈদেশিক আমদানি পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, সেখানে কী অবস্থা হবে?

“বৈদেশিক লেনদেন ও বৈদেশিক দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে যে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা আমাদের সোনার সংসারে আগুন লাগিয়ে দিতে পারে।”

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারের বিভিন্ন হিসাবে দেখা গেছে দেশে বৈষম্য বাড়ছে। যেসব দেশে বৈষম্য কম, তাদেরই প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশি থাকে।

“২০৪১ সালের মধ্যে একটি উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত করতে হলে ১০ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধির দরকার হবে। কিন্তু আমরা নীতি কৌশল ঠিকমতো গ্রহণ করতে না পারলে বাংলাদেশ ‘মিডল ইনকাম ট্র্যাপ’ এ পড়ে যেতে পারে।”

ফাহমিদা খাতুন বলেন, “ব্যাংকিং খাতে আমরা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর ব্যাসেলে-৩ থেকে বের হয়ে ভালোটা ছেড়ে খারাপটার দিকে চলে আসছি।

“দেশে বড় ধরনের বিনিয়োগ আসা শুরু হলে ব্যাংক ঋণ চাইলে দিতে হবে। দিত না পারলে সমস্যা হবে।

তাই দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা ঠিক রাখতে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে।”

মূল প্রবন্ধে ভ্যাট আইন নিয়ে সরকারকে স্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। সরকারের ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও নতুন কৌশল নিতে বলা হয় সরকারকে। 

এতে বলা হয়, সরকার মন্দ ঋণ আদায়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা ভালো হয়নি। আইএমএফের নীতিমালা অনুসরণ না করায় ভালো ঋণগ্রহীতারা ক্ষতিগ্রস্ত এবং মন্দ গ্রহীতারা লাভবান হচ্ছে।

সরকার ব্যাপক বিনিয়োগ চাইলেও বিনিয়োগ সহজ করতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে সিপিডির পর্যবেক্ষণ। এজন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) অগ্রণী ভূমিকা পালনের উপর জোর দিয়েছে তারা।