বাংলাদেশের অর্থনীতির হাল হকিকত নিয়ে প্রকাশিত এডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক ২০১৯ এ প্রবৃদ্ধির এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে এডিবির আবাসিক প্রতিনিধি মনমোহন প্রকাশ বুধবার সংস্থার ঢাকা কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন এডিবি করেছে, তা সরকারের হিসাবের চেয়ে কিছুটা কম হলেও এডিবির আগের পূর্বাভাসের চেয়ে অনেকটা বেশি।
অর্থবছরের প্রথম আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যে প্রাক্কলন করেছে, তাতে ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ।
গত অর্থবছর ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পাওয়ার পর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করে সরকার।
তবে গতবছর সেপ্টেম্বরে এডিবির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রবৃদ্ধির হার এবার হতে পারে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
সেই অবস্থান থেকে এডিবি সরে আসছে কেন জানতে চাইলে মনমোহন প্রকাশ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তাদের আগের হিসাব ছিল তিন মাসের তথ্যের ভিত্তিতে। এখন নয় মাসের তথ্যে দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি বদলে গেছে।
তাছাড়া চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দ্বন্দ্বের কারণেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ কিছু পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে জানিয়ে এডিবির আবাসিক প্রতিনিধি বলেন, এ বিষয়টিও প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
“এখন বাংলাদেশের উচিত হবে কীভাবে এই প্রবৃদ্ধিকে আরও মানসম্পন্ন, অন্তর্ভূক্তিমুলক, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব করা যায় সেদিকে নজর দেওয়া।”
“ইতোমধ্যে সরকার ব্যাংক খাতের যে সংস্কার শুরু করেছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে একটি সুশৃংখল ও শক্তিশালী ব্যাংক ব্যবস্থার জন্য।”
চলতি অর্থবছরের ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলনকে ‘খুবই ভাল’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্ববাসীর কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে।”
এডিবি ঢাকা কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ সুন চ্যান হং বলেন, রপ্তানি খাতে ১২ দশমিক ৫ শতাংশের মত প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি ভালো রেমিটেন্স প্রবাহের কারণে ব্যক্তি খাতে চাহিদা বেড়েছে। পাশাপাশি অবকাঠামো খাতে সরকারের বাড়তি বিনিয়োগ হচ্ছে। মূল্যস্ফীতিও সরকার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এসব কিছুর সম্মিলিত প্রাপ্তিই হচ্ছে উচ্চ প্রবৃদ্ধি।
“এ অর্থবছর শিল্প খাতের ওপর ভর করেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের শক্তিশালী এ প্রবৃদ্ধি ২০২০ সালেও চলমান থাকতে পারে।”
এডিবির এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির গতি ধরে রাখতে হলে আগামীতে শিল্পায়নের ভিত্তি বাড়াতে হবে। বৈচিত্র্য আনতে হবে রপ্তানি পণ্যে। ব্যক্তি খাতের উন্নতি নিশ্চিত করতে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে হবে।
“পাশাপাশি করের ভিত্তি বাড়িয়ে সরকারের ব্যয় নির্বাহ করতে রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তিখাতের চাহিদা মেটাতে মানব সম্পদের উন্নয়ন করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের সংস্কারেও গুরুত্ব দিতে হবে।”
এবারের রেকর্ড প্রবৃদ্ধির পেছনে নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছে এডিবি।
বছরের বাকি সময়টাতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে- এমন আশা প্রকাশ করে সুন চ্যান হং বলেন, “এর হাত ধরে আগামী অর্থবছরেও বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারবে।”
চলতি অর্থবছরে কৃষি খাতে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং শিল্প খাতে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করেছে এডিবি।
তবে যানবাহন, শিক্ষা, আর্থিক খাত ও স্বাস্থ্য খাতের ধীরগতির কারণে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪ শতাংশের আশেপাশে থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে আমদানি বাড়লেও এ খাতের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের মধ্যেই থাকবে বলে মনে করছে এডিবি।।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যপণ্য ও ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কম থাকায় ২০১৯-২০ অর্থবছরেও দেশে আমদানি প্রবৃদ্ধিতে বড় কোনো হেরফের হবে না।
চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয় ১১ শতাংশ বাড়ার সম্ভাবনা দেখা গেলেও পরের অর্থবছরে তা ১০ শতাংশে নেমে আসতে পারে বলে মনে করছে এডিবি।
সুখবরের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও দেখছে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী এ সংস্থা। এডিবির বিচারে, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ এবং দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হবে সবচেয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার বেশি। বিনিয়োগের তুলনায় লাভের হার কম। এখানে সুশাসন ব্যবস্থাও দুর্বল। এর ফলে বাড়ছে মূলধন ঘাটতির প্রবণতা। ব্যাংক খাতে পরিচালনায় ও আইনি কাঠামোয় বড় ধরনের অদক্ষতা রয়েছে বলেও মনে করে এডিবি।”
এ অবস্থা থেকে উঠে আসার জন্য ব্যাংকে সুশাসন ও বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার ওপর গুরত্ব আরোপ করেছেন এডিবির অর্থনীতিবিদ।
পাশাপাশি করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ঋণের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা যাচাই করা, সরকারি ব্যাংকে একীভূতকরণের মত উদ্যোগ বাস্তবায়ন করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করছে এডিবি।