বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭.৩%

বাংলাদেশ সরকার চলতি অর্থবছর শেষে প্রথমবারের মত আট শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির  প্রত্যাশা করলেও বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে তা হতে পারে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।  

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 April 2019, 09:04 AM
Updated : 4 April 2019, 12:45 PM

বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও ‘অনেক’ মন্তব্য করে বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি রবার্ট জে শোম বলেছেন, বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত বাড়তে থাকা পাঁচ অর্থনীতির একটিতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক কার্যালয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির হাল হকিকত নিয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট: রেগুলেটরি প্রেডিক্টেবলিটি ক্যান সাসটেইন হাই গ্রোথ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হলেও রপ্তানি ও রেমিটেন্সে ভর করে বাংলাদেশ চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পেতে পারে।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “রপ্তানি, আমদানি, রাজস্ব আদায়, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং সরকারি বিনিয়োগসহ অর্থনীতিক সূচকগুলো বিশ্লেষণ করে চলতি অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি হবে বলে আমরা ধারণা করছি।”

গত অর্থবছর ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পাওয়ার পর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার।

কিন্তু অর্থবছরের প্রথম আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যে প্রাক্কলন করেছে, তাতে অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি বুধবার তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকে যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তা সরকারের প্রাক্কলন থেকে সামান্য কম হলেও বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাসের চেয়ে বেশি।  

এডিবি মনে করছে, রপ্তানি ও সরকারি বিনিয়োগে ইতিবাচক ধারা অব্যহত থাকায় বাংলাদেশ এবার ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেতে পারে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “এটা তাদের কাছে জানতে চাইতে পারেন, আমাদের হিসেবে আমরা এটা পেয়েছি।”

বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি রবার্ট জে শোম এ সময় বলেন, “এই প্রবৃদ্ধি অনেক, বিশ্বে যে পাঁচ দেশের জিডিপি সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি।”

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে ইথিওপিয়া (৮.৮%), রুয়ান্ডা (৭.৮%), ভুটান (৭.৬%) এবং ভারতের (৭.৫%) জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারই কেবল বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যাংক খাতের সংস্কার, রাজস্ব আদায় বাড়ানোসহ অর্থনীতির বড় বড় খাতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সংস্থাটির এই কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

অর্থনীতির চালচিত্র

প্রতিবেদনের তথ্য উপস্থাপন করে জাহিদ হোসেন বলেন, গত কয়েক বছর দেশে প্রবৃদ্ধির শক্তিশালী দিক ছিল সরকারি বিনিয়োগ। কিন্তু এবার সে চিত্রে পরিবর্তন এসেছে। এবার কিছুটা রপ্তানিভিত্তিক প্রবৃদ্ধির ধারা দেখা যাচ্ছে।

ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হিসাবে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে পোশাক খাতের ১৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ৭ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মেগা প্রকল্প এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সও জিডিপি বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখছে বলে জানান তিনি। 

“বাংলাদেশে বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে। গত ১৭ বছরে দেশে মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার গড়ে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা সৃষ্টির ক্ষেত্রে এটি অবদান রাখেছে।”

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশি বিনিয়োগের হার সামান্য বাড়লেও সমতুল্য দেশগুলোর তুলনায় তা অনেক কম।

চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ১০৬ কোটি ৫০ হাজার ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে ৯৬ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল।

অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এলসি নিষ্পত্তি ৪ দশমিক ৩ শতাংশ কমার পাশাপাশি মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে এলসি খোলার হার ২৩ শতাংশ কমে গেছে।

জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকলেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। রাজস্ব আয় এখনও দুর্বল, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতাও কমছে।

“এবারও রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি খুবই কম। গত সাত মাসে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৭ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি খরচ করতে পারলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না।”

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রাজস্ব বাড়ানোর সম্ভাবনা থাকলেও প্রশাসনিক সক্ষমতার অভাবে আদায় কম হচ্ছে বলে মনে করেন ব্শ্বি ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ।

তিনি বলেন, “আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ১৩৪টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১০৯তম। আবার মানব সম্পদ উন্নয়ন সূচকেও আমাদের অবস্থা করুণ। এক্ষেত্রে ১৫৭টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১০৬তম।”

জাহিদ হোসেন বলেন,“ সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান ঘাটতি হচ্ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে। শিক্ষায় মানের অভাব আর স্বাস্থ্যে পুষ্টির অভাব।”

দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীল নীতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন হলে তা ভালো ফল বয়ে আনে না।”

খেলাপী ঋণ

খেলাপী ঋণকে দেশের আর্থিক খাতের ‘প্রধান দুর্বলতা’ হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, খেলাপী ঋণ ৩ শতাংশ বাড়লে ৬টি ব্যাংক, ৯ শতাংশ বাড়লে ২৯টি ব্যাংক এবং ১৫ শতাংশ বাড়লে ৩৫টি ব্যাংকের মূলধনে ঘাটতি দেখা দেবে।

আবার ভালো ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে ৩ শতাংশ গ্রহীতা খেলাপী হলে ২১টি, ৭ শতাংশ হলে ৩১টি এবং ১০ শতাংশ খেলাপী হলে ৩৫টি ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি তৈরি হবে।

“যদি এই দুটি খাতে একই সময়ে সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তবে এ সম্ভাবনা খুবই কম।”

জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহের অপর্যাপ্ততা ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের কারণ। দুটি বিষয় একই সূত্রে গাঁথা।

এই অবস্থায় টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য আর্থিক খাতের সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ বলেন, “আর্থিক খাত, অবকাঠামো, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং ব্যবসায়িক বিধি-নিয়ম কার্যকর করতে হবে।”

ব্যাংক খাতের সংস্কারের বিষয়টি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “খেলাপি ঋণ একটি ছোঁয়াচে রোগ, ঋণ পুণঃতফশীলিকরণ এটি আরও বাড়িয়ে দেয়।”

এরপর কী

বিশ্ব ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ পূর্বাভাস দেন, ২০১৯ সালের পর বিশ্ব অর্থনীতি শ্লথ হয়ে আসতে পারে। ভূ-রাজনীতি, তেল সরবরাহ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ এবং ব্রেক্সিট এর প্রধান কারণ হতে পারে।

“কিন্তু এই স্লো ডাউনের মধ্যেও বাংলাদেশ ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারবে বলে আমরা মনে করছি। তবে ঝুঁকিও আছে।”

জাহিদ হোসেনের ভাষায়, এই ঝুঁকি হচ্ছে আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক অর্থনীতির ঝুঁকি।

“বৈদেশিক অর্থনীতির ঝুঁকি অর্থনৈতিক চাতুর্য দিয়ে এ সঙ্কট মোকাবিলা করতে হবে।আর আভ্যন্তরীণ ঝুঁকির মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির জায়গা হলো ব্যাংক খাত। আরেকটা ঝুঁকির জায়গা রাজস্ব আদায়ে অপর্যাপ্ততা। এছাড়া অন্যান্য ঝুঁকি যেগুলো ছিল তা মোটামুটি কেটে গেছে।”