দেশের ব্যাংকিং খাতের নাজুক পরিস্থিতির ব্যাপকতা বোঝাতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, গত কয়েক বছরে এ খাতের নিয়মনীতি স্থূলভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।
Published : 08 Dec 2018, 06:36 PM
তিনি বলেছেন, গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতে উন্নয়নের বদলে অবনতি হয়েছে।
গুলশানের একটি হোটেলে শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে কী করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
সভায় বক্তাদের কাছ থেকে নতুন সরকার গঠনের পর দেশের ব্যাংকিং খাত ঢেলে সাজানোর জন্য একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব এসেছে।
সভার প্রধান অতিথি ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ ব্যাংকিং খাতের নিয়ম লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরে বলেন, “দেশের ভিতরে আমি এই প্রথম দেখেছি সাধারণ মানুষ, ব্যাংকের আমানতকারীরা প্রশ্ন করতে শুরু করেছে যে কোন ব্যাংকে রাখলে তার আমানত নিরাপদ থাকবে। এর আগে কখনোই আমি এই প্রশ্নের সম্মূখীন হইনি।”
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সমস্যার বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান বহন করতে হয় এই ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এবং কিছু রাজনৈতিক প্রভাবশালী এই ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে অনৈতিকভাবে নিয়মবহির্ভূতভাবে যে ঋণ নেন সে ঋণ পরিশোধ না করে পার পেয়ে যান।”
তবে সব রাজনৈতিক প্রভাবশালীই ঋণ খেলাপী হন না বলে মন্তব্য তার।
অন্যদিকে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ঠিক না করেই বেসরকারি ব্যাংকের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল বলে মত দেন তিনি।
তিনি বলেন, “এটি একটি সাংঘাতিক বিষয়। নিয়মকানুন ঠিক না করে এক চেটিয়া ব্যবাসার সুযোগ করে দেওয়া মানে পুরো অর্থনীতিকে কিছু কিছু ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি করে ফেলা। এটি কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না।”
সভায় বাংলাদেশ বাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমাদের সরকারি ব্যংকগুলো জবাবদিহি নয়। এটা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে।”
ব্যাংকিং খাতের দুরাবস্থার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতাকেই দায়ী করে তিনি বলেন, “দেশের ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতিতে আমি খুশি নই, আবার আতংকিতও নই। তবে এটা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতার কারণে হয়েছে বলে আমি মনে করি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঠিক মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এটা ঠিক করা সম্ভব। আমি মনে করি আমাদের ব্যাংকিং সেক্টর এখনো ধ্বংসের পথে যায়নি।”
“একটি ব্যাংকের পরিচালন মুলধনের মাত্র ৭ থেকে ৯ শতাংশ অর্থের যোগান দেয় মালিকপক্ষ। আর ৯০ শতাংশের মতো যোগান দেন আমানতকারীরা। কিন্তু পরিচালনা বোর্ডে যারা নির্বাচিত হন তারা মালিকপক্ষের স্বার্থ রক্ষা করেন। ৯০ শতাংশের মালিক জনগণের পক্ষে কেউ থাকেনা।”
তিনি বলেন, “সম্প্রতি একজন ব্যাংক মালিক সমিতির সভাপতি ঋণ আমানত সুদের হার ৯-৬ বলে ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রীর দোহাই দিয়ে। আর ধমক দিলেন কোনো এমডি এটা না মানলে তাকে পদচ্যুত করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ তার সরকারের স্পোকসম্যান ঘোষণা করবেন। অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রীর স্পোকসম্যান নন। তাছাড়া কোনো এমডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো ক্ষমতা তার নেই। এগুলো কিসের আলামত?”
সাবেক ডেপুটি গভর্নর বলেন, “আগে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু সরকারের নিয়োজিত রাজনৈতিক চেয়ারপারসন খেলাপি ঋণ ৮০ শতাংশে নিয়ে গেলেন। অথচ তাকে সরকার কিছুই করতে পারল না। এমনকি দুদকও না। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের দিন তিনি পদত্যাগ করে চলে গেলেন। অথচ সরকার তার কিছুই করল না।”
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তিথ্যের ভিত্তিতে জানান গত দশবছরে ব্যাংক খাতে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১৩ সাল থেকে সরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন চাহিদা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমানে বেসিক ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামি ব্যাংকের র্মূলধন আশংকাজনকভাবে কম। ২০১৮ সালের জুনের হিসাব অনুযায়ী সরকারি ব্যাংকের মন্দ ঋণের পরিমাণ ২৮ দশমিক ২ শতাংশ। এটা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
দেশে অতিরিক্ত ব্যাংক অনুমোদন দেওয়ার সমালোচনা করে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, মেক্সিকোর অর্থনীতি বাংলাদেশের অর্থনীতির ৭.৪ গুণ বেশি হওয়ার পরও তাদের মাত্র ৪৭টি ব্যাংক, আর বাংলাদেশে ৫৪টি। সম্প্রতি আরও কয়েকটি অনুমোদন দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের এভাবে অতিরিক্ত ব্যাংক দেওয়া হচ্ছে বলে জনগণের অর্থের জবাবদিহিতা কম বলে এতে উল্লেখ করা হয়।
সভার সঞ্চালক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “দেশের বর্তমান ব্যাংকিং ব্যবস্থার এই কঠিন সময় থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে আর্থিক খাতকে নিষ্কৃতি দিতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের এমন প্রণোদনা সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা ব্যাংকিং খাত সুষ্ঠুভাবে বিকশিত হতে সহায়তা করবে।”
তিনি আগামী নির্বাচনের পর একটি ব্যাংক কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেন।