রেশন দিলে যে হাজার পাঁচেক কোটি টাকার প্রয়োজন হবে তা জাতীয় বাজেটের আকারের তুলনায় নগণ্য মনে করেন এমএম আকাশ।
Published : 29 Apr 2024, 06:12 PM
উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব কাটাতে পোশাক শ্রমিকদের রেশনিংয়ের আওতায় আনার প্রস্তাব করেছেন রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন।
তিনি বলেছেন, মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশে নেমে না আসা পর্যন্ত তাদের রেশন দিতে পারলে জাতীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ঠিক থাকবে।
সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এমন প্রস্তাব করেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র আয়োজিত এ বৈঠকে অর্থনীতিবিদ, তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তা, শ্রমজীবী মানুষ ও শ্রমিক নেতারা আলোচনা করেন।
সাধারণ মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছুঁইছুঁই করলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির চাপ সবচেয়ে বেশি পড়ে শ্রমজীবীদের উপর।
‘গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আসন্ন বাজেটে বরাদ্দ’ শীর্ষক আলোচনায় বিনায়ক সেন বলেন, এই চাপ কমাতে রেশনিং ব্যবস্থা কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে।
“রেশন বাবদ শ্রমিক প্রতি অন্তত এক হাজার টাকা ভর্তুকি দিলে মাসে ৪০০ কোটি টাকা লাগবে। বছরে যা প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো। সরকার জাতীয় বাজেটে এ পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিতে পারে টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) মাধ্যমে।”
বর্তমানে টিসিবির মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে সারা দেশে এক কোটি দরিদ্র পরিবারের কাছে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এ তালিকার এক তৃতীয়াংশ ‘মিস টার্গেট’ (যারা যোগ্য না) হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার এই তালিকা সংশোধন করে শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
বর্তমানের উচ্চ মূল্যস্ফীতি ধনী, দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের উপর ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলে মন্তব্য করে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “মানুষের জীবনে খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। দেশে এটি নিয়ে গবেষণা হতে পারে যে, সার্বিক ও খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে কোন শ্রেণির মানুষের উপর কেমন প্রভাব ফেলে। শ্রমিকরা দরিদ্র শ্রেণির হওয়ায় তাদের রেশন দিলে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, শ্রম অসন্তোষ কমবে।”
অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ বলেন, “তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের দিয়েই সরকার রেশনিংটা শুরু করতে পারে। কারখানা মালিকপক্ষকে সরকার সহায়তা দিলে এটি সম্ভব। এজন্য সরকারকেই বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে। ক্ষুধা নিয়ে শ্রমিকরা কাজ করলে দেশকে ক্ষুধামুক্ত করতে সরকারের যে প্রতিশ্রুতি, তা অর্জন করা সম্ভব হবে না।”
রেশন দিলে যে হাজার পাঁচেক কোটি টাকার প্রয়োজন হবে তা জাতীয় বাজেটের আকারের তুলনায় নগণ্য মনে করেন এমএম আকাশ।
আলোচনায় অংশ নিয়ে তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, “কোভিড-১৯ এর পর ও বৈশ্বিক যুদ্ধাবস্থার কারণে কারখানা মালিকদের সক্ষমতা নেই রেশন দেওয়ার। সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারখানা মালিকরা তো মুনাফার একটি অংশ প্রতিবছর সরকারের শ্রমিক উন্নয়ন তহবিলে জমা করছে।”
কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন চালুর পক্ষে থাকার দাবি করে তিনি বলেন, “এটি হতে হবে সংশ্লিষ্ট কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে। তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন কিন্তু বাইরের কেউ তাতে যোগ দিলে সমস্যা তৈরি হবে।”
বাংলাদেশ ট্রেড উন্নয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, “সব পক্ষই শ্রমিকদের রেশন দেওয়ার পক্ষে কিন্তু কেন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না তা বোধগম্য নয়। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে রাষ্ট্রকে কল্যাণমূলক কাজের দিকেই যেতে হবে। শ্রমিকদের বাদ দিয়ে তো কল্যাণ রাষ্ট্রের চিন্তা করা যাবে না।”
তৈরি পোশাক খাত নারী কর্মীদের উপর টিকে আছে জানিয়ে মহিলা পরিষদের সভাপতি ফৌজিয়া মোসলেম বলেন, “তৈরি পোশাক খাতে সরকার যে প্রণোদনা দিচ্ছে তা শিল্পের বিকাশে কাজে লাগছে, নাকি বিদেশে অর্থপাচার হচ্ছে তা দেখা দরকার। নারীরা আজ ঘর থেকে বেরিয়েছে বলে সস্তা শ্রম পাওয়া যাচ্ছে। শিল্পে তাদের যে অবদান তা মূল্যায়ন করতে রেশন দিতে হবে।
তৈরি পোশাক খাত শ্রমনির্ভর হওয়ায় ৩৫ বছরের পর কোনো নারী কাজে থাকতে পারছেন না, আবার যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় নারীর কর্মসংস্থান কমছে সবচেয়ে বেশি।
নারীদের উপর ভর করে চলা শিল্পে এখন নারী বাদ পড়ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, নারী উন্নয়নে এ বিষয়টি সরকারের নজরে আনা দরকার। নারীকে অর্থনীতির মূল স্রোতে রাখতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
তৈরি পোশাকসহ সব খাতের শ্রমিকদের রেশন দেওয়া ভুর্তকি নয়, এটি অর্থনীতিতে বিনিয়োগ মন্তব্য করে আয়োজক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রুহুল আমিন বলেন, “ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দিতে হবে নিজেদের প্রয়োজনেই। বিদেশি শক্তি বলার পরে তা দিলে, তাদের মতো করেই দিতে হবে।”
সভাপতির বক্তব্যে ইদ্রিস আলী বলেন, সব পক্ষই শ্রমিকদের রেশন দেওয়ার পক্ষে এসেছে। সরকার বাজেটে বরাদ্দ দিলে জাতীয় উৎপাদনে এই শ্রমিকরাই আরো বেশি অবদান রাখতে পারবে।