‘‘স্থানীয় মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে কমিয়ে রাখা ভালো,’’ বলেন তিনি।
Published : 30 Apr 2024, 09:41 PM
টাকার মান দীর্ঘদিন ধরে না রেখে সময়ে সময়ে ডলারের সঙ্গে সমন্বয় করলে অর্থনীতির উপর একবারে চাপ পড়ত না বলে মনে করছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান।
তার ভাষ্য, চাপটি ধীরে ধীরে এলে তা সহনশীল হত। তাতে টাকার মান কমে যাওয়ার ধাক্কা ব্যবসায়ীদের ওপর একবারে আসত না।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ’স ডমেস্টিক রিসোর্স মোবিলাইজেশন: ইমপারেটিভস অ্যান্ড এ রোডম্যাপ’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
কোভিড মহামারী থেকে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সময় ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে ডলারের চাহিদা বাড়তে থাকে। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করে বসলে আন্তর্জাতিক বাজারের দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে ডলারের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। তখন থেকে সরবরাহ সঙ্কটে দাম বেড়ে ডলারের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়।
বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার অংশ হিসেবে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) ডলারের দর নির্ধারণ করছে। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১৭ ডিসেম্বর থেকে ডলারের বিনিময় হার ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা বেঁধে দেওয়া আছে।
অথচ কোভিড মহামারীর শুরুতেও এই বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকার মত।
মসিউর রহমান বলেন, ‘‘টাকার মান এক জায়গায় ধরে না রেখে ডলারের সঙ্গে ধীরে ধীরে সমন্বয় করতে দিলে ব্যবসায়ীরা আগাম ধারণা পেতেন। তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে সহজ হতো। সেটি না করায় গত কয়েক বছরে চাপটি একসঙ্গে বেড়েছে।
‘‘পর্যায়ক্রমে দর সমন্বয় করলে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতির উপর তা সহনশীল আকারে পড়তো। এতটা চাপে পড়তেন না ব্যাবসায়ীরা।’’
পৃথিবীর অনেক দেশ এখনো ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা প্রয়োজনের চেয়েও অবমূল্যায়ন করে রেখেছে। তাতে রপ্তানি খাত সম্প্রসারিত হয়।
বাংলাদেশও সেই নীতিতে যেতে পারত মন্তব্য করে মসিউর বলেন, ‘‘স্থানীয় মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে কমিয়ে রাখা ভালো।’’
টাকার মান হারানোয় উদ্যোক্তরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মন্তব্য করে এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘টাকার মান পড়ে যাওয়ায় গত চার বছরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আমাদের এ ক্ষতি কীভাবে পুশিয়ে দেওয়া যায় তা সরকারের ভাবা দরকার।
“ডলার ক্রাইসিস (সংকট) এখনো কাটেনি। ব্যাংক থেকে ১১৫-১৬ টাকা দরে ডলার কিনতে হচ্ছে আমদানি করতে গেলে। কখনো কখনো তা আরো বেড়ে যায়।’’
গত জুলাইয়ে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশের সীমা তুলে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। স্মার্টরেটের সঙ্গে তা প্রতি মাসেই সমন্বয় করায় ব্যাংক ঋণের সুদহার এখন ১৪ শতাংশের ঘরে।
সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসার খরচ বেড়েছে বলে অনুষ্ঠানে দাবি করেন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম।
এ প্রসঙ্গে মসিউর রহমান বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে ব্যাংক ঋণের সুদহার র্নিধারণের বিষয়ে বলা আছে, সুদহার হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট অনুযায়ী। সেখানে সুদের হর নির্ধারণ করার কথা বলা হয়নি।’’
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট বা নীতি সুদহার হচ্ছে ৮ শতাংশ। কিন্তু এই নীতি সুদহার অনুযায়ী সুদহার র্নিধারণ করা হচ্ছে না। ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের উপর ভর করে ‘স্মার্ট (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল)’ রেট প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্মার্ট রেটের সঙ্গে আরো মার্জিন যোগ করে গ্রাহক পর্যায়ে বর্তমান সুদহার দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১৪ শতাংশে।
মূল প্রবন্ধে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উপর জোর দিয়ে পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘রাজস্ব আদায়ের এমন সক্ষমতা নিয়ে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত হতে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আগামীতে দেশি-বিদেশি ঋণ সুদ পারিশোধ, মজুরি বৃদ্ধিতে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাবদ, ভর্তুকি ও পেনশন খাতে খরচ বাড়বে সরকারের। এই বাড়তি খরচ মেটাতে রাজস্ব আদায় না বাড়ালে অর্থনীতির ঝুঁকিটা বাড়বে।’’
কর কাঠামো ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংস্কার, আর্থিক খাতে দেওয়া আইএমএফের সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করলে আগামী চার বছরে অতিরিক্ত ৬০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করা সম্ভব বলে মত দেন আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, ‘‘ব্যাপক সংস্কার বাস্তবায়ন না করলে ২০৪১ সাল শেষে ৫০ লাখ কোটি টাকার রজস্ব ক্ষতি হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি অতি জরুরি।’’
কেবল ব্যবস্থাপনায় সংস্কার করলেই রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহম্মব্দ আব্দুল মজিদ।
‘‘রাজস্ব আদায় বাড়াতে কর ছাড় কমানোসহ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দর্শন যোগ করতে হবে। যাতে করছাড় কমানো যায়।’’
বর্তমানে উদ্যোক্তারা বিভিন্ন খাতে ১২০ ধরনের করছাড় সুবিধা ভোগ করছেন। গত ২৫ বছর ধরে কিছু খাত এই ছাড় সুবিধা ভোগ করছে।
তাদের ছাড় কমিয়ে নিজস্ব সক্ষমতার উপর দাঁড় করানোর ওপর জোর দেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান।
তিনি বলেন, ‘‘কর ছাড় দেওয়ার সুযোগগুলো যৌক্তিকীকরণের সময় হয়েছে। দেশকে এগিয়ে নিতে ব্যবসায়ীদের কর ছাড় না নেওয়ার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে।’’
ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধি পেয়ে ব্যবসার খরচ বাড়ছে, ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘পুঁজিবাজারের বন্ড বাজারটি উন্নয়নের সময় হয়েছে। ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের বদলে পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করতে পারেন।
“তাহলে ব্যাংকমুখী সুদ থেকে বাঁচতে পারবেন। ব্যাংকের উপর থেকেও তারল্য চাপ কমে আসবে। অর্থনীতির উন্নয়নে পুঁজিবাজারমুখী হতে হবে।’’
বাণিজ্য শুল্কের উপর নির্ভরতা কমিয়ে এনে প্রত্যক্ষ কর আহরণে জোর দেয়ার পরামর্শ দেন পিআরআই চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার।
সেমিনারে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, প্রতিবছর একটি করে খাতকে নীতি সুবিধার জন্য বাছাই করে এনবিআর। নীতি সুবিধা দেওয়ার কারণেই এখন সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়েছে।
“আমরা চাই আমদানি নির্ভরতা কমে দেশীয় শিল্পখাত বিকশিত হোক। মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে বিশাল বাজার রয়েছে, তার সুবিধা ভোগ করছে বিদেশি অর্থনীতি। দেশীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যবিত্তের সেই চাহিদা পূরণ করতে যে সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন, তা এনবিআর দিবে।”