গ্যাসের সরবরাহ বাড়ল, সংকট কতটা কাটল

কিছু এলাকার কারখানায় গ্যাসের চাপ বাড়লেও সব এলাকায় তা ঘটেনি।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 March 2023, 04:26 PM
Updated : 1 March 2023, 04:26 PM

আট মাস পর গ্যাসের জাতীয় সরবরাহ ব্যবস্থায় যুক্ত হল খোলা বাজারের (স্পট মার্কেট) এলএনজি। সরবরাহ বাড়ায় কিছু শিল্প এলাকায় গ্যাসের চাপ বাড়লেও সব এলাকায় তা ঘটেনি।

শিল্প মালিকরা বলছেন, গত এক সপ্তাহে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় দিনের বেলায় গ্যাসের চাপ বেড়েছে। তবে নরসিংদী ও ময়মনসিংহের ভালুকা এলাকায় বেশ কিছু শিল্পে এখনও সন্ধ্যার পর গ্যাস বন্ধ থাকছে।

ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর জ্বালানির বিশ্ব বাজার অস্থির হওয়ায় গত সাত মাসে খোলা বাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রেখেছিল সরকার।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই সময়কালে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ ২৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে ২৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মধ্যে ছিল। ফেব্রুয়ারিতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা শুরু হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির এলএনজির পাশাপাশি খোলা বাজারের জোগান দিয়ে দৈনিক সরবরাহ ৩ হাজার এমএমসিএফডিতে ধরে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

খোলা বাজার থেকে এলএনজি কেনার প্রক্রিয়া ফের শুরুর পর ১৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় কার্গো (৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ) এলএনজি কেনা নিশ্চিত করা হয়। প্রতি ইউনিট ১৮ ডলারে প্রথম চালান কেনার ১৫ দিনের মাথায় প্রতি ইউনিট সাড়ে ১৬ ডলারে দ্বিতীয় কার্গো কেনা গেছে।

দেশে নতুন শিল্প কারখানা বাড়তে থাকায় গ্যাসের চাহিদা মেটাতে ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেট থেকে নয় কার্গো (প্রতি কার্গোতে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ) এলএনজি আমদানি করেছিল সরকার। পরে একদিকে ডলার সংকট, অন্যদিকে এলএনজির মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

তাতে দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট আরও প্রকট হয়ে ওঠে। গ্যাসের অভাবে অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ রাখতে হয়। তবে ডিসেম্বরে শীত শুরু হওয়ায় গ্যাস ও বিদ্যুতের চাহিদা কমে আসে; পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে।

Also Read: চার মাস ধরে কাজ শুরুর অপেক্ষায় একটি কারখানা

Also Read: গরমে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানি হচ্ছে: প্রধানমন্ত্রী

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির দাম গত ২০২২ সালের অগাস্টে রেকর্ড ৭০ দশমিক ৫০ ডলারে (এমএমবিটিইউ) ওঠে, যেখানে ২০২১ সালে প্রতি ইউনিট ১১ থেকে ১২ ডলারে কিনছিল সরকার।

সংকট কতটা কাটল?

গত জুলাই মাসে গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনও মারাত্মক ব্যাহত হয়। ফলে একই সঙ্গে দেশের সব শ্রেণির গ্রাহক গ্যাস-বিদ্যুতের ভোগান্তিতে পড়েন।

অগাস্ট মাসের দিকে দৈনিক সর্বো্চ্চ দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দেয়। আর গ্যাসের উৎপাদন কমে ২৪০০ এমএমসিএফডি থেকে ২৫০০ এমএমসিএফডিতে নেমে আসে।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি ভাসমান টার্মিনালে খোলা বাজারের এনএনজি যুক্ত হওয়ার আগে আমদানি করা গ্যাসের সরবরাহ ছিল ৪০০ থেকে ৪৯০ এমএমসিএফডি। মাসের বাকি কয়েক দিনে সরবরাহ বেড়ে ৫৬৯ এমএমসিএফডিতে উন্নীত হয়। আর সব মিলিয়ে গ্যাসের মোট সরবরাহ বেড়ে হয় প্রায় ২৮০০ এমএমসিএফডি।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে আগমী জুন পর্যন্ত সময়ে গ্যাসের দৈনিক সরবরাহ তিন হাজার এমএমসিএফডির বেশি রাখা। কারণ, গরমের মওসুম হওয়ায় এই সময়ে চাহিদা বেশি থাকবে। এই চাহিদা পূরণে জুন পর্যন্ত সময়ে খোলা বাজার থেকে ১২ কার্গো এলএনজি কেনার বিষয়ে সরকারের সবুজ সংকেত পাওয়া গেছে।

“এর বাইরে দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তির আলোকে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫৬ কার্গো এলএনজি আমদানি আগে থেকেই নিশ্চিত হয়ে আছে।”

পেট্রো বাংলার আরেকজন কর্মকর্তা জানান, বাড়তি গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য ২০০ থেকে ৩০০ এমএমসিএফডি গ্যাস বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া শিল্প কারখানাগুলো যাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পায়, সেজন্য শিল্প লাইনে সরবরাহ বাড়ানো হবে।

যোগাযোগ করা হলে ময়মনসিংহের ভালুকা এলাকায় অবস্থিত একটি সিরামিক কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত এক সপ্তাহে দিনের বেলায় গ্যাসের চাপ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু আগের মতোই সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সময়ে গ্যাস প্রায়ই বন্ধ থাকছে।

“পাশেই একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সেখানে গ্যাস দেওয়া হয়। আর আমাদের প্রয়োজন মেটাতে আমরা সিএনজি গ্যাসের ওপর নির্ভর করি।”

বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গাজীপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কিছু এলাকায় গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক হলেও নরসিংদী ও ময়মনসিংহে এখনও সমস্যা রয়ে গেছে।

“বিশেষ করে নরসিংদীতে আমার নতুন একটি কারখানা চালু করা আছে যেখানে গ্যাসের কারণে বেশ সমস্যা হচ্ছে।”

খোলা বাজার থেকে বাড়তি দামে এলএনজি কিনে জাতীয় গ্রিডের সংকট দূর করতে গত জানুয়ারির মাঝামাঝিতে সরকার গ্যাসের দাম সর্বোচ্চ ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়।

নতুন মূল্য তালিকা অনুযায়ী, জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম আগের ৫ টাকা ০২ পয়সা থেকে ১৭৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ বাড়িয়ে ১৪ টাকা, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রতি ইউনিট ১৬ টাকা থেকে ৮৭ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে।

বৃহৎ শিল্প খাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে ১৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ টাকা, মাঝারি শিল্পে প্রতি ইউনিট বর্তমান ১১ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে ১৫৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ টাকা এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে বর্তমান ১০ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে ১৭৮ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমানে শিল্পায়নের প্রসারের কারণে গ্যাসের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। কেউ বলছে প্রকৃত চাহিদা ৩৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট, আবার কেউ বলছে ৩৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ চাহিদা পূরণ করা না গেলেও আমরা ৩০০০ মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে নামতে চাচ্ছি না।