কঠিন সময়েও দারিদ্র্যের হার কমার সুখবর

দেশে এখন অতি দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ; ২০১৬ সালে যা ১২ দশমিক ৯ শতাংশ ছিল।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2023, 09:00 AM
Updated : 12 April 2023, 09:00 AM

কোভিড মহামারীর পর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমার খবর দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো- বিবিএস।

বুধবার পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত ‘খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২’ প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যের হার আরো কমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। ২০১৬ সালের জরিপে এই হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২০ সালে বিবিএস এর প্রাক্কলনে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।

নতুন জরিপে দেশে অতি দারিদ্র্যের হারও কমেছে অনেকটা। বিবিএস বলছে, দেশে এখন অতি দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬ সালের জরিপে এই হার ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। বিবিএস এর ২০২০ সালের প্রাক্কলনে অতি দারিদ্র্যের হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশ দেখানো হয়েছিল। 

বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পরিসংখ্যান ভবনের সম্মেলন কক্ষে এক অনুষ্ঠানে জরিপের তথ্য প্রকাশ করেন প্রকল্প পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ।

তিনি জানান, পল্লী এলাকার বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহরে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে অতি দারিদ্র্যের হার গ্রামে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ, শহরে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।

কোভিড মহামারীর ধাক্কার পর ইউক্রেইন যুদ্ধের দুঃসময়েও দেশে দারিদ্র্যের হার কীভাবে কমল, সে বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

তার যুক্তি, কোভিডের সময় সরকার পুরোপুরি লকডাউনে না গিয়ে সতর্ক অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি শিল্প, কৃষক এবং প্রান্তিক মানুষসহ সকল স্তরের মানুষের জন্য নানা ধরনের প্রণোদনা দেওয়ার ফলে দেশে এই দুঃসময়েও দারিদ্র্য কমেছে।

এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোভিডের সময় আমরা যে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ঝুঁকি নিয়েছি, আমরা কমপ্লিট লকডাউনে যাই নাই। সিলেক্টিভ লকডাউন আমরা করেছি। তখন অনেক জ্ঞানী ব্যক্তিরা বলেছিলেন, সর্বনাশ হয়ে যাবে, রাস্তা ঘাটে মানুষ মরে পড়ে থাকবে।

“কিন্তু আমরা রাস্তাঘাট বন্ধ না করে বিশেষ করে শ্রমিক ও কৃষকদের চলাফেরা বন্ধ করিনি। এর ফলে আমাদের শিল্প ও কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। কারখানার উৎপাদন, এসএমইর উৎপাদন এবং বহিরাগত শ্রমিক যাওয়া আসা প্রত্যেকটি বিষয় আমরা ধরে রাখতে পেরেছিলাম।”

মান্নান বলেন, ওই সময়ে সরকার ‘দেশের সকল স্তরের’ মানুষের জন্য বিভিন্নভাবে প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছিল। কম মূল্যে চাল দিয়েছিল। এসব কিছুর সম্মিলিত ফলে এই কঠিন সময়েও দেশের অর্থনীতি এগিয়ে গেছে এবং দারিদ্র্যের হার কমেছে।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. শামসুল আলমও উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।

এবারের খানা আয় ও ব্যয় জরিপে সারা দেশে ১৪ হাজার ৪০০ পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বছরব্যাপী এই তথ্য সংগ্রহের কাজ চলে।

জরিপের অন্যান্য খাতে দেখা যায়–

  • দেশে বর্তমানে ৯৯ দশমিক ৩২ শতাংশ খানা বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। ২০১৬ সালে এই হার ছিল ৭৫ দশমিক ৯২ শতাংশ।

  • ৭ বছরের বেশি বয়সীদের সাক্ষরতার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ শতাংশ। ২০১৬ সালের জরিপে এই হার ৬৫ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল।

  • বর্তমানে দেশের ৯৬ দশমিক ১ শতাংশ খানা নিরাপদ পানি পাচ্ছে।

  • এখন দেশের ৯২ দশমিক ৩২ শতাংশ খানা উন্নত টয়লেট, ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ অনুন্নত টয়লেট ব্যবহার করে। তবে এখনো ০.৬৯ শতাংশ উম্মুক্ত স্থানে মল ত্যাগ করে।

বেড়েছে মাসিক আয় ব্যয়

জরিপের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশের সকল খানার মাসিক গড় আয় বেড়ে ৩২ হাজার ৪২২ টাকা হয়েছে। ২০১৬ সালের জরিপে খানার মাসিক গড় আয় ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা।

মাসিক গড় মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ৬১৪ টাকা। এই অংক ছয় বছর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৬ সালে মাথাপিছু গড় আয় ছিল ৩ হাজার ৯৪০ টাকা।

নতুন জরিপে খানার গড় ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। ২০১৬ সালে এই ব্যয় ছিল ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা।

বর্তমানে প্রায় ১৪ দশমিক ১ শতাংশ খানার অন্তত ১ জন সদস্য আগের ১২ মাসে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন, যা ২০১৬ সাল ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।

ভোগ ব্যয়ও বেড়েছে

বর্তমানে খানাপ্রতি গড়ে ভোগব্যয় বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার ৬০৩ টাকা, যা ২০১৬ সালে ১৫ হাজার ৪২০ টাকা ছিল।

এর মধ্যে খাদ্য বাবদ গড় ব্যয় হচ্ছে ১৪ হাজার ৩ টাকা, খাদ্য বহির্ভূত খাতে ব্যয় হচ্ছে ১৬ হাজার ৬০০ টাকা। ২০১৬ সালের জরিপে এই দুই খাতের ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৭ হাজার ৩৫৪ টাকা এবং ৮ হাজার ৬৬ টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে নাগরিকদের প্রত্যেকে গড়ে প্রতিদিন ৩২৮ গ্রাম চাল, ২২ দশমিক ৯ গ্রাম আটা, ১৭ দশমিক ১ গ্রাম ডাল, ২০১ দশমিক ৯ গ্রাম সবজি, ৬৭ দশমিক ৮ গ্রাম মাছ, ৪০ গ্রাম মাংস, ১২ দশমিক ৭ গ্রাম ডিম, ৩৪ দশমিক ১ গ্রাম দুধ এবং ৯৫ দশমিক ৪ গ্রাম ফল খাচ্ছেন।

সার্বিকভাবে বর্তমানে দেশের মানুষ মাথাপিছু ২ হাজার ৩৯০ কিলোক্যালরি গ্রহণ করছেন। ২০১৬ সালে এটি ছিল ২ হাজার ২১০ কিলোক্যালরি।

আয় বৈষম্য বেড়েছে

জরিপের তথ্য বলছে, দেশের সামস্টিক অর্থনীতির এত সফলতার মধ্যেও দেশে আয় বৈষম্য বেড়েছে।

২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী দেশে আয় বৈষম্য বেড়ে শুন্য দশমিক ৪৯৯ শতাংশ হয়েছে। ২০১৬ সালের জরিপে এই হার ছিল শুন্য দশমিক ৪৮২ শতাংশ।

 এখন প্রতিটি খানার সদস্য সংখ্যা গড়ে ৪ দশমিক ২৬ জন, যা আগের জরিপে ছিল ৪ দশমিক ০৬ জন।

৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ খানার প্রধান পুরুষ এবং ১২ দশমিক ৬ শতাংশ খানার প্রধান নারী। আগের জরিপে এই হার ছিল যথাক্রমে ৮৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং ১৩ দশমিক ১ শতাংশ।