আইএমএফের ঋণ চাওয়া নিয়ে অস্পষ্টতা: অর্থমন্ত্রী বললেন, এটা ‘কৌশল’

বাংলাদেশ যে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছে, তা স্বীকার করে তিনি বলেছেন, ‘দর কষাকষির সুবিধার জন্য’ তিনি চার দিন আগে সংবাদমাধ্যমকে অন্য কথা বলেছিলেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 July 2022, 10:04 AM
Updated : 27 July 2022, 10:04 AM

আর্থিক খাতের আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে দুই রকম কথার ব্যাখ্যা দিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

বাংলাদেশ যে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছে, তা স্বীকার করে বুধবার তিনি বলেছেন, ‘দর কষাকষির সুবিধার জন্য’ তিনি চার দিন আগে সংবাদমাধ্যমকে অন্য কথা বলেছিলেন।

“আমি যদি আমার চাহিদা এক্সপোজ করে দিই, তাহলে আমার ওপর ঋণের বার্ডেন বা কস্ট তারা বেশি নেবে। সেজন্য ‘নেব, নিচ্ছি, বা প্রয়োজন নেই,’ এই কথাগুলো বলে ম্যানেজ করতে হয়। তাতে করে আমরা লাভবান হই।”

চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে আইএমএফফের কাছ থেকে বাংলাদেশের ঋণ চাওয়ার বিষয়টি বেশ কিছু দিন ধরেই আলোচনায় রয়েছে।

গত সপ্তাহে সংস্থাটির একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে এসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করলে সেই আলোচনা আরও জোর পায়।

Also Read: ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ: আইএমএফ

Also Read: এই মুহূর্তে আইএমএফের ঋণের প্রয়োজন নেই: অর্থমন্ত্রী

তবে গত সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তা নাকচ করে বলেন, “বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আইএমএফের কাছে কোন অর্থ সহায়তা চায়নি। আইএমএফও বাংলাদেশের কাছে এ ধরনের কোনো প্রস্তাব করেনি। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের আইএমএফের কোন সহযোগিতার প্রয়োজন নেই।”

কিন্তু মঙ্গলবার কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে আইএমএফ এর কাছে বাংলাদেশের ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা চাওয়ার খবর আসে।

বাংলাদেশ যে ঋণ চেয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে, আইএমএফ এর একজন মুখপাত্রও মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তা নিশ্চিত করেন।

বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রী। তখন তিনি আইএমএফকে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নেন।

‘দরকার নেই’ বলার পরে কেন গত রোববার আইএমএফকে ওই চিঠি পাঠানো হল, সেই প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমরা ডলার প্রিন্ট করি না, ডলার অর্জন করতে হয়। রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে আমরা ডলার অর্জন করি। এর মাঝে খারাপ কিছু হয়নি।

“এটা খুব সহজ জিনিস। আপানারা আমার জায়গায় থাকলে একই কাজ করতেন। আমরা বার্গেইন করে এভাবে ঋণ নিই। শক্ত কোনো টার্ম অ্যান্ড কন্ডিশনস যেন ঋণের মধ্যে ঢুকে না যায়, সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হয়।”

অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমরা অর্থ চাইব বলেছি। কিন্তু কত লাগবে সেটা আমরা বলি নাই। তারা কী শর্তে দিতে চাচ্ছে আমরা সেটা দেখব। তারা যদি পজিটিভলি এগিয়ে আসে এবং কম রেটে পাই, তাহলে ইন দ্যট কেইস, আমরা বিবেচনা করতে পারি। আমরা বিবেচনা করবই- এমন কোনো প্রস্তাব আমরা দিইনি।”

আইএমএফকে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি কেন প্রকাশ করা হল না- তা জানতে চাইলে মুস্তফা কামাল বলেন, “তখন ওদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হচ্ছিল। আমরা চাচ্ছিলাম আমাদের সক্ষমতাগুলো তারা বুঝুক। সে কারণে তখন এটা পাবলিক করা হয়নি। আমরা ভালোভাবেই হ্যান্ডেল করে যাচ্ছি।“

বাংলাদেরে যখন ঋণ প্রয়োজন হয়, তখন বিশ্ব ব্যাংক, জাইকা- সব জায়গাতেই চেষ্টা করা হয় মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, “আমরা চাই ভালো শর্তে, ভালো সুদহারে ঋণ। এখানেও যদি সেই সময় আইএমএফ টিমের নিয়মিত বার্ষিক পরামর্শ দল এসেছে; তারা প্রতিবছরই আসে। সেই সময় যদি আমি বলি যে আমার টাকার দরকার, তখন তারা টাকাটা দিলেও সুদহার বাড়ানোর শঙ্কা থাকে।

“গ্রাহক হিসাবে আমরা খুব বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করি। আমরা ভাব দেখাই যে, আমাদের টাকা দরকার নেই। এগুলো আমরা বলি। এটা ভালোর জন্য করা হয়েছে, দেশের স্বার্থে করা হয়েছে। এতে করে টাকা পয়সার কোনো লেনদেন হয়নি।

Also Read: বাজেট সহায়তা পেতে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশ

Also Read: বাংলাদেশসহ এশিয়ার যেসব দেশের জন্য শ্রীলঙ্কা সতর্ক সঙ্কেত

সরকারের ওই চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমএফ সদর দপ্তরের একজন মুখপাত্র মঙ্গলবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশ আইএমএফের রেসিলিয়ান্স অ্যান্ড সাসটেইনেবলিটি ফ্যাসিলিটিস বা আরএসএফ ফান্ড থেকে অর্থ পাওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার বিভিন্ন পদক্ষেপ এগিয়ে নিতে অর্থ ব্যবহার করা হবে বলে তারা জানিয়েছে। আইএমএফের এই প্রকল্পের অর্থ পেতে আলাপ-আলোচনা শুরু করার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ।”

আইএমএফ বাংলাদেশকে অর্থ সহায়তা দিতে ‘প্রস্তুত’ জানিয়ে ওই মুখপাত্র বলেন, আইএমএফের প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করে একটি প্রকল্প প্রস্তুত করার কাজে হাত দেবে।

মহামারীর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের অভিঘাতে শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হওয়ার প্রান্তে না পৌঁছলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিও ঝুঁকির মুখে বলে আইএমএফের মূল্যায়ন।

সঙ্কট বড় নয় বলে বাংলাদেশ সরকার দাবি করে এলেও জ্বালানি বাজারে অস্থিরতার কারণে জ্বালানির আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে ইতোমধ্যে রিজার্ভে টান পড়েছে।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোসহ ব্যয় সাশ্রয়ী নানা পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্যেই আইএমএফ থেকে ঋণ চাওয়ার খবরটি এল।

যে তহবিল থেকে বাংলাদেশ অর্থ চেয়েছে বলে আইএমএফের তরফে বলা হচ্ছে, তা থেকে নিম্ন আয়ের দেশ ও ঝুঁকিপূর্ণ মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে ঋণ দেওয়া হয়।

কোভিড মহামারী এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবেলার জন্য নীতি সহায়তার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেওয়া হয় এই প্রকল্পে।

২০ বছর মেয়াদে এই ঋণ দিয়ে থাকে আইএমএফ, তার প্রেস পিরিয়ড ১০ বছর। আর ঋণে সুদের হার আলোচনার মধ্য দিয়ে ঠিক হবে।

ব্যাংকের সুদহার

আইএমএফ ৬/৯ সুদের হার (আমানতে ৬ শতাংশ, ঋণে ৯ শতাংশ) উঠিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেছে বলে যে খবর এসেছে সে বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর অবস্থান জানতে চান সাংবাদিকরা।

উত্তরে মুস্তফা কামাল বলেন, ৬/৯ নীতির কারণেই বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা এখন ‘বেশ ভালো’।

“যদি সুদহার ২০/২২ শতাংশে চলে যেত, তাহলে কোভিডকালে ছোট, বড় মাঝারি শিল্প কারখানাকে আমরা হাতে পেতাম না। এগুলোকে খুঁজেও পাওয়া যেত না। ব্যাপক কর্মহীনতার সৃষ্টি হত। সব বিষয়ে আমরা বিয়োগাত্মক অবস্থায় চলে যেতাম। এটা আমাদের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত।

“আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংক তারা তাদের কথা বলবে। কিন্তু আমি মনে করি, তারা আমাদের সঙ্গে একমত হবে। তারা বরাবরই বলে যাচ্ছে বাংলাদেশ উদ্যোগগুলো নিয়ে ভালো করছে।”

মন্ত্রী বলেন, “আমাদের ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল অবস্থায় আসছে। সরকারি ব্যাংকগুলোকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছি। আগে তাদেরকে রিফাইন্যান্সিং করা হত। পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলো লাল ক্যাটাগরি থেকে সবুজে এসেছে।”