বাংলাদেশসহ এশিয়ার যেসব দেশের জন্য শ্রীলঙ্কা সতর্ক সঙ্কেত

গভীর এবং নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কা গত কয়েকমাস ধরে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে আছে। বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়েই পালিয়েছেন।

নিউজডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 July 2022, 03:15 PM
Updated : 18 July 2022, 04:50 PM

এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশে একই পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান।

শনিবার আইএমএফ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা বলেন, ‘‘যেসব দেশের উচ্চমাত্রার ঋণ আছে এবং নীতিমালার পরিসর সীমিত তাদেরকে বাড়তি চাপের মুখ পড়তে হবে। তাদের জন্য শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি একটি সতর্কবার্তা।”

গত চারমাস ধরে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের টেকসই মূলধনের বহিঃপ্রবাহ দেখছে, যা তাদের উন্নত অর্থনীতির সাথে যুক্ত হওয়ার স্বপ্নকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় শ্রীলঙ্কা তদের দুই কোটি ২০ লাখ মানুষের জন্য অতি প্রয়োজনীয় খাবার, জ্বালানি ও ওষুধ আমদানি করতে পারছে না। সেখানে মূল্যস্ফীতি ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে। এক বছর আগের তুলনায় খাবারের দাম ৮০ শতাংশ বেড়ে গেছে।

এ বছর মার্কিন ডলার এবং অন্যান্য প্রভাবশালী মুদ্রার বিপরীতে শ্রীলঙ্কার রুপির ব্যাপক অবমূল্যায়ন হয়েছে। এজন্য দেশটির বেশিরভাগ মানুষ সাবেক প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন। কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

বছরের পর বছর ধরে বিপুল পরিমাণ ঋণ করেছে শ্রীলঙ্কা। গত মাসে দেশটি তাদের বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গত ২০ বছরে এই প্রথম কোনো দেশ বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলো।

বেলআউট সুবিধা পেতে শ্রীলঙ্কা কর্তৃপক্ষ আইএমএফ-র সঙ্গে দেনদরবার করছে। তারা আইএমএফ থেকে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার বেলআউট সুবিধা চায়। কিন্তু দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা থমকে আছে।

শুধু শ্রীলঙ্কা নয় বরং ওই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের অর্থনীতিকেও বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির, উচ্চ সুদের হার, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, উচ্চ ঋণ এবং দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বৈশ্বিক ঝড় মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

এসব উন্নয়নশীল দেশগুলোর কয়েকটিতে ঋণদাতা দেশ হিসেবে চীনের আধিপত্য রয়েছে এবং চীন গুরুতর উপায়ে এসব দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবে চীনের ঋণের শর্তগুলো কী এবং কীভাবে তারা ঋণ পুনর্গঠন করবে, তা অনেকটাই অস্পষ্ট।

এই অঞ্চলের দেশগুলোর বর্তমান কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হওয়ার দায় চীনের উপরও বর্তায় বলে মনে করেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক অ্যালান কিনান। তিনি বলেন, চীন ওইসব দেশকে এমন সব ব্যয়বহুল অবকাঠামো প্রকল্প করতে উদ্বুদ্ধ করছে, যার বদলে ওইসব প্রকল্প থেকে বড় ধরনের কোনো অর্থনৈতিক অর্জন আসছে না।

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আর কোন কোন দেশ শ্রীলঙ্কার মত অবস্থায় পড়ার ঝুঁকিতে আছে তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিবিসি।

 বাংলাদেশ

বাংলাদেশে গত মে মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় জরুরি নয়, এমন পণ্য আমদানি বন্ধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার।

প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স পেতে বিভিন্ন বিধান শিথিল করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের বিদেশে ভ্রমণও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংসের বিশ্লেষক কিম আং তান বিবিসি-কে বলেন, ‘‘আমদানি আয় ও রপ্তানি ব্যয়ের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ঘাটতিতে থাকা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা সরকারকে ভর্তুকি বাড়ানো নিয়ে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হবে। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা এরই মধ্যে অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য আইএমএফ ও অন্য দেশের সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে।”

বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দিয়ে কিম আং আরও বলেন, ‘‘বাংলাদেশকে সরকারি ব্যয়ের বিষয়টিকে পুনরায় অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং ভোক্তা পর্যায়ে কেনাকাটার উপরও বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে।”

পাকিস্তান

পাকিস্তান সরকার জ্বালানি তেলের উপর ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় গত মে মাস থেকে দেশটিতে জ্বালানি তেলের দাম ৯০ শতাংশ বেড়ে গেছে।

দেশটি এখন তাদের খরচের লাগাম টানতে চাইছে। একইসঙ্গে একটি বেলআউট কর্মসূচি শুরু করতে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা করছে।

দেশটিতে পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। গত জুন মাসে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ২১ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

শ্রীলঙ্কার মতো পাকিস্তানেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। গত বছরের আগস্টের তুলনায় তা প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে।

দেশটির সরকার এক বছরের জন্য বড় আকারের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উপর ১০ শতাংশ কর আরোপ করেছে। যাতে তারা ১৯৩ কোটি মার্কিন ডলার পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করতে পারে।

তারা সরকারের রাজস্ব ও খরচের মধ্যকার ব্যবধান কমানোরও চেষ্টা করছে। দেশটির কাছে আইএমএফের বেঁধে দেওয়া শর্তগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।

এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংসের বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু উড বিবিসি-কে বলেন, পাকিস্তান সরকার যদি এসব তহবিল সংগ্রহ করতে পারে, তবে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো ঋণসীমা বাড়াতে আগ্রহী হতে পারে।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের কিছু সমস্যার সমাধান করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে। যদিও টালমালাট অর্থনীতি তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার একমাত্র কারণ নয়।

গত মাসে পাকিস্তান সরকারের এক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী দেশটির জনগণকে চা খাওয়ার পরিমাণ কমানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। পাকিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে বড় চা আমদানিকারক দেশ। চা আমদানির জন্য বছরে ৫১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার খরচ করে দেশটি।

পাকিস্তানের অর্থনীতিতে চীনের ভূমিকাও রয়েছে। পাকিস্তান তাদের মোট ঋণের এক চতুর্থাংশের বেশি চীনের কাছ থেকে নিয়েছে।

মালদ্বীপ

মালদ্বীপে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি ঋণের পরিমাণ বাড়তে দেখা গেছে এবং এটি এখন তাদের জিডিপির তুলনায় ১০০ শতাংশের উপরে।

শ্রীলঙ্কার মতো পর্যটন খাতের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল এ দেশটির অর্থনীতিতেও করোনা মহামারীর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। সাধারণত পর্যটন নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোতে উচ্চমাত্রায়

সরকারি ঋণের অনুপাত দেখা যায়।

যদিও বিশ্বব্যাংক বলছে, মালদ্বীপ সুনির্দিষ্টভাবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি জনিত কারণে ঝুঁকিতে আছে। কারণ দেশটির অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যাংক জেপিমর্গান বলছে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ মালদ্বীপ বৈদেশিক ঋণের কিস্তি প্রদাণে ব্যর্থ হতে পারে।

লাওস

পূর্ব এশিয়ার ভূমিবেষ্টিত দেশ লাওসে ৭৫ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। দেশটি গত কয়েক মাস ধরেই বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।

ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর পুরো বিশ্বের মত সেখানেও জ্বালানি তেল এবং নিত্যপ্যণ্যের দাম বেড়েছে। লাওসের একতৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, লাওসে জ্বালানি সংগ্রহের জন্য মানুষকে দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। কোনো কোনো পরিবার তাদের ইউটিলিটি বিল চুকাতে পারছে না।

চলতি বছর লাওসের মুদ্রা কিপের মান মার্কিন ডলারের তুলনায় এক শতাংশের বেশি অবমূল্যায়িত হয়েছে। দেশটির সরকারকে আমদানি খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, গত বছরের ডিসেম্বরে লাওসের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার।

তবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেশটিকে একই পরিমাণে ঋণ শোধ করে যেতে হবে, যা দেশটির মোট দেশজ রাজস্বের প্রায় অর্ধেক। জলবিদ্যুৎকেন্দ্র ও রেলওয়ের মতো বড় বড় প্রকল্পগুলোর জন্য গত কয়েক বছরে লাওসকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ দিয়েছে চীন।

লাওসের কর্মকর্তাদের বরাতে চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া বলেছে, দেশটিতে গত বছর এক হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের ৮১৩ প্রকল্পে একাই অর্থায়ন করেছে বেইজিং।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে লাওসের সরকারি ঋণের পরিমাণ ছিল দেশটির মোট জিডিপির ৮৮ শতাংশ। এ ঋণের প্রায় অর্ধেকই চীনের কাছ থেকে নেওয়া।

বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, দেশটিতে কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা চলছে। ১৯৭৫ সাল থেকে দেশটিতে একটি দলই (লাও পিপল’স রেভল্যুশনারি পার্টি) ক্ষমতায় আছে।