‘অর্থপাচার ও ব্যাংক থেকে টাকা লোপাট বন্ধ’ হওয়ার দাবি করা হলেও এখন অর্থনীতি আরও কেন শক্ত হচ্ছে না, সেই ব্যাখ্যাও দেন তিনি।
Published : 24 Mar 2025, 09:51 PM
অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক একের পর এক খারাপ হতে থাকায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ‘অবধারিতভাবে’ টিকে থাকতে পারত না বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
শেখ হাসিনার সরকার থাকাকালেও দু-এক জায়গায় এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরার কথা বর্ণনা করে তিনি বলেন, “অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমার এবং অনেকের কাছেই হয়ত এরকম মনে হয়েছিল অর্থনৈতিক সূচকের দিক থেকে অর্থনীতি যেদিকে যাচ্ছিল, যেভাবে যাচ্ছিল, এটা অবধারিত ছিল যে কোনো না কোনো সময় এই সরকার আসলে টিকতে পারবে না।"
দেশের ব্যাংকিং খাত ও রিজার্ভের পতন যেভাবে হচ্ছিল তা দেখে এমন অনুমান ছিল বলে তুলে ধরেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা।
সোমবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এনইসি সম্মেলন কক্ষে উন্নয়ন সাংবাদিকদের সংগঠন ডেভেলপমেন্ট জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশের ‘উন্নয়ন সংলাপে’ তিনি এসব কথা বলেন।
বর্তমান সরকারের সময়ে ‘বিলিয়ন টাকা চলে যাচ্ছে না, ব্যাংকগুলো থেকে আর লোপাট হচ্ছে না, সেটা বন্ধ হয়েছে’ দাবি করে উপদেষ্টা বলেন, এখন প্রশ্ন হতে পারে, এসব বন্ধ হলেও অর্থনীতি আরও কেন শক্ত হচ্ছে না।
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “শক্ত না হওয়ার কারণ আছে দুই দিক থেকে। কারণ আছে, ব্যাংকগুলোকে এখন রক্ষা করা হচ্ছে। কোনো ব্যাংককেই আর একদম মানে উঠে (দেওলিয়া) যেতে দেওয়া হচ্ছে না।
“এগুলো অন্তত করা যাচ্ছে। তাতে অনেক অসুবিধা হচ্ছে। অনেক টাকা ছাপাতেও হচ্ছে। অনেক ব্যাংকে আর্থিকভাবে অন্তত কিছু মূলধন দেওয়া হচ্ছে। সেটা খুব কঠিন কাজ তবু ব্যাংকিং খাতকে তো রক্ষা করা যাচ্ছে।”
ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এর তিন দিন পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
সরকার পতনের আগের সময়কার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় যেভাবে যাচ্ছিল সেটা বেশি দিন ওইভাবে যেতে পারত না। এই অর্থনীতি এবং সেখানে সরকারও তখন আর টিকে থাকতে পারত না।
"মনে হতে পারে যে আমি এখন জেনে বলছি কিন্তু আমি আসলেই আমার অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ থেকে আমি তখন বলছিলাম দুই এক জায়গায়। আমি এ ধরনের মন্তব্য করেছিলাম তখন। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে বলেছিলাম যে আপনারা সমানে টাকা ছাপিয়ে কিন্তু বেশিদিন ঠিক করলেন না।"
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, "এই অর্থনীতি নিয়ে বেশি দিন আর চলা যেত না। একটা হল যে যেভাবে সম্পদ পাচার হচ্ছিল প্রতিবছর বিশেষ করে শেষের দিকে। এইটার তো অনেক হিসাব আছে কিন্তু অনুমান নির্ভর শুধু যে বছরে দুই, তিন না চার বিলিয়ন পাচার হয়ে যাচ্ছিল।
"এভাবে পাচার হতে থাকলে যেভাবে রিজার্ভ কমে যাচ্ছিল... যেখান থেকে দ্রুত কমে যাচ্ছিল এভাবে কমে যেতে থাকলে, এই বৈদেশিক লেনদেন টিকত না। এটা ব্যাংক্রাফট হয়ে যেত।"
ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, “অন্য আরেকটা জায়গা সেটা হল ব্যাংকগুলোতে যে খালি করে নেওয়া হচ্ছিল, ব্যাংকের যারা প্রতিষ্ঠাতা, যারা উদ্যোক্তা পরিচালক তাদেরই তো শেয়ার, তাদেরই তো ব্যাংকের ভালো দেখার কথা।
“ব্যাংকে কত মুনাফা হবে সেটা ডিভিডেন্ড তাদের পাওয়ার কথা সেটা তো তাদের মাথায় ছিল না। তখন তারা তো পুরো ব্যাংকে খালি করে যেভাবেই হোক বৈধ-অবৈধভাবে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা তো পরিষ্কার জানতেন যে এই ব্যাংক আর টিকবে না।"
‘নিজের ব্যাংকে নিজেই লাল বাতি জ্বালিয়ে দেওয়ার’ কথা তারা ঠিকই বুঝতেন, বলে নিজের মন্তব্যের স্বপক্ষে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন তিনি।
এ অবস্থায় কিছু ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যেত বলে মনে করেন তিনি। বলেন, মানুষ তার আমানত বিশ্বাসের উপর রাখে। সেই বিশ্বাস যখন চলে যায়, সবাই যদি আগে আমানত তুলে আনতে চায়, সেটা পাঁচ ভাগের এক ভাগ হলেও তা আর ব্যাংকে থাকে না।
“কাজেই তো একটা অসম্ভব ব্যাপার। যদি সবাই চায় যে আমি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে আনব। ব্যাংক তো টাকা সঞ্চয় রাখে না। তারা তো ঋণ হিসেবে দিয়ে দেয়। সেটা খেলাপি হতে থাকলে, খেলাপি হতে থাকলে এক কথা। এবং আমরা আগের কালে মনে করতাম কত খেলাপি হচ্ছে কিন্তু শেষের দিকে তো আর খেলাপির ব্যাপার না, শেষে হল আমার ব্যাংকের টাকা আমি সব নিয়ে যাব (পাচার করব)।”
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক খাতের পুনর্গঠনে যে পরিকল্পনা করেছে সেটি তিনি দেখেছেন এবং আরও ভালো করে দেখবেন বলে তুলে ধরেন। ব্যাংকিং খাত কী করে আস্তে আস্তে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তা ওই পরিকল্পনায় রয়েছে, যোগ করেন তিনি।
পাচার না হলেও এখন কেন রিজার্ভ বাড়ছে না বরং কমছে কিছুটা, এর ব্যাখ্যায় উপদেষ্টা বলেন, "এই যে এখন কেন দৃশ্যমান হচ্ছে না ওই যে এত বিলিয়ন ডলার চলে যাচ্ছিল। তার আরেকটা হল এই যে, কীভাবে যেত। একটা হল হুণ্ডির মাধ্যমে চলে যেত।
“যে বিদেশে শ্রমিকদের যত টাকা আছে তারা এখানে টাকায় দিয়ে ওখানে নিয়ে যেত। এই যে এই নয় মাসে (অর্থবছরের) গত বছরের তুলনায় চার বিলিয়ন বেশি রেমিটেন্স এসেছে।”
এর পেছনে হুণ্ডি দিয়ে টাকা পাচার না হওয়াই মূল বিষয় বলে তিনি মনে করছেন।
তিনি বলেন, “আমি জানি না এটা গবেষণার বিষয়। আমার একটু ধারণা হল এই সময়ের মধ্যে তো অনেক বেশি মানুষ বিদেশে যায়নি। কিন্তু বিদেশের ওই যে হুণ্ডি দিয়ে পাচার হওয়া এটা কমা খুব সম্ভবত। এটা একটা কারণ। যে কারণে ৪ বিলিয়ন ডলার মত বেশি গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এই বছর এসেছে।
“কিন্তু তারপরও আমাদের বৈদেশিক লেনদেন এবং রিজার্ভে এখনো টানাটানি তার একটা কারণ হল ঋণ পরিশোধ, এ বছর গত বছরের থেকেও বাড়ছে। ভবিষ্যতে আর বাড়বে।
“আরেকটা হল যে আমাদের যদিও রপ্তানিও বেড়েছে কিন্তু আমাদের বৈদেশিক সাহায্য এবং এফডিআই এগুলো সব মিলে গত বছরের তুলনায় তিন-চার বিলিয়ন কম হয়েছে।”
এই সরকারকে বিদেশি ঋণ দেওয়ার মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিলেও তা না আসার কারণও তুলে ধরেন উপদেষ্টা। বলেন, “অনেকে বলছে যে এই সরকারকে বৈদেশিক ঋণদাতারা এত সাহায্য দিতে চায় কিন্তু কোথায় সেসব? বরং আগের থেকে কমে যাচ্ছে। তার একটা কারণ হল আমরা তো প্রকল্পগুলো চালু রাখতে পারছি না আবার নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে। মাঝখানে বন্ধ হয়ে গেছিল। কাজেই এটা একটা।
“আর খুব সঙ্গত কারণেই এখন এফডিআই যেটা ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট এটা এই সময়, এই অস্থিরতার মধ্যে এখন তো আসার কথা না। কাজেই সেটাও গত বছরগুলোতে যা এসেছে এই সাত মাসে-আট মাসে তার থেকে কম আসছে। কাজেই এজন্যই টাকা পাচার হচ্ছে না, সেটা দৃশ্যমান হচ্ছে না।”