নবায়নযোগ্য জ্বালানিই বিকল্প, বাজেটে চাই পথরেখা: শফিকুল আলম

আইইইএফএ এর এই জ্বালানি বিশ্লেষক বলছেন, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ ইউনিট প্রতি ১০ টাকা অতিক্রম করেছে। সেই তুলনায় সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ আরও কম হতে পারে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 May 2023, 05:54 AM
Updated : 30 May 2023, 05:54 AM

বিশ্বজুড়ে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, ডলার সঙ্কটের মধ্যে দেশের মানুষকে বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে স্বস্তি দিতে কম খরচের সৌরিবিদ্যুৎ সরকারের জন্য ‘ভালো একটি বিকল্প’ হতে পারে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম।

তার মতে, এজন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে সুলভে টেকসই জ্বালানি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সৌর বিদ্যুতের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।

আগামী ১ জুন জাতীয় সংসদে তোলা হবে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব। তার আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জ্বালানি সঙ্কট থেকে বের হওয়ার কিছু পরামর্শ দিয়েছেন শফিকুল।

সৌরবিদ্যুতই বিকল্প?

শফিকুল আলম বলেন, “আগামী বাজেট বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে সুলভ মূল্য ও টেকসই খাতের দিকে নিয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ। যেহেতু বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে দেশেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানির খরচ অনেক বেড়ে গেছে, তাই কম মূল্যের দীর্ঘস্থায়ী সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প হতে পারে সরকারের জন্য একটা ভালো বিকল্প।”

তার ‍যুক্তি, বর্তমানে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ প্রতি ইউনিট ১০ টাকা অতিক্রম করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেই তুলনায় সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ আরও কম হতে পারে।

“বাণিজ্যিকভাবে প্রতি ইউনিট ৮ টাকায় সৌরবিদ্যুৎ দেওয়া গেলে সেটা জাতীয় বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয়কে কমিয়ে আনতে সহযোগিতা করবে।”

জ্বালানি সঙ্কটের পেছনে সাম্প্রতিক ডলার সঙ্কটেরও একটি ভূমিকা রয়েছে। এই দুই সঙ্কট থেকে উত্তরণে দীর্ঘমেয়াদি প্ররিকল্পনার কথা বলেন শফিকুল।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এবার যখন বাজেট উপস্থাপনের প্রস্তুতি চলছে, তখন দেশে গ্যাস সংকট, বিদ্যুৎ সংকট…। গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ডলার সংকটের কারণে অনেক আন্তর্জাতিক কেনাকাটা করতে না পারার সংকটসহ নানামুখী সমস্যা রয়েছে। এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

“১০/১৫ বছর আগে ছিল সবার জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে না পারা। এখন সক্ষমতা বাড়লেও ইউক্রেইন যুদ্ধ ও অন্যান্য কারণে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। আমরা ডলার সঙ্কটের কারণে গ্যাস ও কয়লা কিনতে পারছি না।”

এক্ষেত্রে তিনি কয়েকটি পরামর্শও দিয়েছেন। সেখানে ঘুরেফিরে নবায়নযোগ্য জ্বালানিই গুরুত্ব পেয়েছে।

“সবার আগে যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে নিজস্ব গ্যাস কীভাবে ব্যবহার করা যায়, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বরাদ্দ দেওয়া। একইসঙ্গে দ্রুত কীভাবে নবায়ণযোগ্য জ্বালানি ও বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, সেদিকে ব্যয় বরাদ্দ করা। পাশাপাশি জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বিলম্বিত করা এবং নতুন করে যেগুলো টেন্ডারে যাবে সেগুলো ডিলে করে দেওয়া। কারণ এখন যেসব প্ল্যান্ট আছে সেগুলো বর্তমান চাহিদার আলোকে যথেষ্ট। ৩০/৪০ বছরের পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যেগুলো ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, সেগুলোকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে কনভার্ট করা।”

সৌরবিদ্যুতে ‘বাড়বে উৎপাদন ক্ষমতা, কমবে খরচ’

শফিকুল আলম বলেন, “বাজাটে যে দিকগুলোর দিকনির্দেশনা থাকা দরকার তা হচ্ছে- নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন বাড়ানো, নিজস্ব জ্বালানির সর্বোচ্চ ব্যবহার ও আমদানি নির্ভরতা কমানো এবং পুরোনো অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে নিয়ে গিয়ে দক্ষ করে তোলা।

“বেসরকারি খাতে পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে সোলার প্লান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়বে এবং খরচ কমে যাবে।” 

রুফটপ সোলারের ক্ষেত্রে এখন ১৫ থেকে ৩৮ শতাংশ আমদানি শুল্ক রয়েছে। স্বল্প সময়ের পরিকল্পনা হিসেবে বাজেটে এটি পুরোপুরি তুলে দেওয়া সম্ভব না হলেও সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “একবার এ ধরনের প্ল্যান্ট স্থাপন করা হলে সেই খরচে টানা ২৫ বছর সুবিধা পাওয়া যাবে, যার দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমে আসবে।”

এছাড়া সোলার ইরিগেশন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নজর দিলে ডিজেলভিত্তিক সেচ থেকে বেরিয়ে এসে প্রচুর অর্থসাশ্রয় করা যাবে বলে মনে করেন তিনি।

ভারতের মত বাংলাদেশেও সোলার প্যানেল উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি বাজেটে রাখা যেতে পারে বলে মনে করেন আইইইএফএ এর জ্বালানি বিশ্লেষক।

তিনি বলেন, সোলার প্ল্যান্ট স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি করতে হবে। ২০০ মেগাওয়াট বা তার চেয়ে বড় প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে ‘উন্মুক্ত দর’ পদ্ধতিতে গেলে খরচ বর্তমান ইউনিটপ্রতি ৭ টাকা থেকে আরও কমে আসবে। রুফটপ সোলারে এখন ইউনিট প্রতি ৫ থেকে ৬ টাকা খরচ হয়। এখানে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হলে প্রতি ইউনিট সাড়ে ৪ টাকায় নেমে আসবে।

“আর বাণিজ্যিক মডেলের ক্ষেত্রে সাড়ে ৭ থেকে ৮ টাকা খরচ পড়বে। এর সঙ্গে বিনিয়োগকারীর লভ্যাংশ যোগ করলেও সেটা প্রচলিত বিদ্যুৎকেন্দ্রেগুলো থেকেও অনেক কমই থাকবে।”

বাজেটে থাকুক ‘সোলার পাওয়ার স্টোরেজের’ পরিকল্পনাও

এক প্রশ্নে শফিকুল আলম বলেন, সৌর বিদ্যুৎ যেহেতু দিনের আলো শেষ হলেই ফুরিয়ে যায়, সে কারণে ২/৩ ঘণ্টার একটি স্টোরেজের পাইলট প্রকল্পের দিকে যেতে পারে সরকার।

“স্টোরেজ এখন অনেক ব্যয়বহুলে হলেও সরকার এই বাজেটে পরীক্ষামূলকভাবে দুই ঘণ্টার স্টোরেজ সুবিধাসহ কিছু সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা নিতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে এর জন্য তহবিল গঠন করতে পারে।” 

এর ফলে বেশকিছু উপকার মিলবে জানিয়ে শফিকুল বলেন, “এতে করে একটা অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ইভিনিং পিক সময়েও যেন সোলার থেকে একটা সাপোর্ট দেওয়া যায়। পাশাপাশি স্টোরেজ সিস্টেমের অভিজ্ঞতা থেকে সরকার একটা গাইডলাইন তৈরির সুযোগ পাবে।”

‘সুলভ মূল্য নিশ্চিতে দরকার মূল্যায়ন’

কীভাবে সুলভ মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে জানতে চাইলে শফিকুল বলেন, যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আছে, সামনে যেগুলো আসবে এবং এর সঙ্গে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকে যোগ করলে কীভাবে সবচেয়ে সুলভ মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে সেজন্য একটি বিশ্লেষণ সরকারকে করতে হবে।

“নিয়মিতভাবে দাম বাড়ানো কিংবা আমদানি নির্ভরতা বেড়ে যাওয়া তো কোনো সমাধান নয়। এটা করতে গেলে আমাদের কী কী লাগবে সেটারও একটা অ্যাকশন প্লান প্রয়োজন।

“বাজেটের পাশাপাশি বিদ্যুতের একটা নিজস্ব বার্ষিক পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। বিদ্যুৎখাতের যে মহাপরিকল্পনা রয়েছে, সেখানে সুলভ মূল্যের বিদ্যুতের জন্য একটা বার্ষিক পরিকল্পনা দরকার, যা অর্জন করা যাবে না সেটা কেন গেল না, সেটারও একটা বিশ্লেষণ থাকা দরকার।”

‘সুযোগ আছে’ শিল্পে জ্বালানির ব্যবহার কমানোর

জ্বালানি আমদানির চাপ কমবে কীভাবে- এমন প্রশ্নে এই জ্বালানি বিশ্লেষক বলেন, সঠিক জ্বালানি ব্যবস্থাপনা ও দক্ষ যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্পখাতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার সুযোগ আছে।

শফিকুল বলেন, ২০২১-২০২২ অর্থবছরের একটা হিসাবে দেখা যায়, গ্যাসের শিল্প সংযোগ ও ক্যাপটিভ বিদ্যুতের সংযোগে বছরে ৩৬৭ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার হয়েছে।

“এটা আমাদের জাতীয় গ্যাস কনজাম্পশানের ৩৬ শতাংশ। আমরা বছরে ২৪০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করেছিলাম। বেসরকারি বা শিল্প সংযোগের অদক্ষতার কারণেই সেখানে গ্যাস খরচ হয়ে যাচ্ছে বেশি।

“শিল্প খাতে কেবল দক্ষতা বা ইফিসিয়েন্সি বাড়ানোর মাধ্যমেই ২০ শতাংশ বা ৭৩ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ব্যবহার কমানো যায়। এটা যদি করা হয় তাহলে গ্যাসের আমদানি ৩০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েও বর্তমান হারে সরবরাহ ব্যবস্থা ধরে রাখা যাচ্ছে। এই কথা বলার অর্থ হচ্ছে, বাজেটে শিল্পে জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার যে মাস্টারপ্লান আছে, সেটা বাস্তবায়নের উদ্যোগ প্রয়োজন। গ্যাসের বড় ভোক্তাদের ব্যবহার কমানোর বিষয়ে একটা টার্গেট ঠিক করে দেওয়া যেতে পারে। কারণ, তাদের জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ আছে।”

জ্বালানি খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এই বিনিয়োগ প্রতিযোগিতামূলক হওয়া উচত বলে মনে করেন শফিকুল ।

তিনি বলেন, “প্রতিযোগতা না থাকলে সুলভ মূল্যের বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে না। মূলতঃ প্রতিযোগিতা ছাড়া কোনো সরকারি প্রকল্পেই দামের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয় না।”