“বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছে,” বলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা।
Published : 10 Mar 2025, 01:08 AM
ব্যাংক থেকে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ চলতি অর্থবছরের প্রথম সাড়ে সাত মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা; শতকরা হিসাবে ৩৪ দশমিক ০৭ শতাংশ।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে সরকারের নিট ব্যাংক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ২০ ফ্রেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংক থেকে সরকারের ধার নেওয়ার স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৯১ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। এরমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ৯৪ হাজার ৪৮ কোটি টাকা এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ ৩ লাখ ৯৭ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা।
আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া সরকারের মোট ব্যাংক ঋণের স্থিতি ছিল ৪ লাখ ৬ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা।
হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যত টাকা ঋণ নিয়েছে তার চেয়ে বেশি টাকা পরিশোধ করেছে। সাত মাস ২০ দিনে ৬১ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৩২ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা। এ হিসাবে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯০ শতাংশ বেশি পরিশোধ করেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ওই সময়ে ৩২ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছিল সরকার।
অপরদিকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে সাত মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ৭৮ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা, যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই পরিমাণ ছিল ৪৫ হাজার ২৩১ কোটি টাকা। এ হিসাবে ঋণ নেওয়া বেড়েছে ৭৪ দশমিক ২৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ বেশি পরিশোধ করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে জানুয়ারিতে এক দশকের সর্বনিম্ন ৭ দশমিক ১৬ শতাংশে নেমেছে। কারণ ঋণ চাহিদা আগের চেয়ে কমেছে; ব্যবসা ও নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে কম।
“ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিয়েই ব্যবসা করতে হয়। তবে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছে। উচ্চ মুনাফার সঙ্গে এখাতে বিনিয়োগে ঝুঁকি কম, কারণ সরকারকে ঋণ দিলে সেই অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে।”
ওই কর্মকর্তার বক্তব্য ফুটে উঠেছে পরিসংখ্যানেও। ২০২০ সালের জুনে যেখানে ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ ছিল ৬৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা, সেখানে ২০২৪ সালের জুন শেষে তা দাঁড়ায় ১ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা।
অপরদিকে ২০২০ সালে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ ছিল ২ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের জুন শেষে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকায়।
তবে ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল ও বন্ডে মনোযোগ দেওয়ায় বেসরকারি খাত যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেই বাস্তবতাও সামনে আসছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ১৬ শতাংশ, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এ বাস্তবতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি বলেছেন, “ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শুয়ে শুয়ে টাকা আয় করছে। সামনে এখাতের সুদের হার কমানো হবে।”
এরপর ফেব্রুয়ারিতে ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার কমায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার পরিমাণ ১০৭ থেকে ১৮১ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত। এর আগে ট্রেজারি বিল-বন্ডে সুদ পাওয়া যেত প্রায় ১২ শতাংশ পর্যন্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ হয়েছে ৩ লাখ ৯৭ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা।
ব্যবসায়ীদের কণ্ঠে হতাশার সুর
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তা বাড়ানোর দাবি তুলেছেন উদ্যোক্তারা।
শিল্পগোষ্ঠী মেঘনার চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বাড়ালে বেসরকারি খাতে প্রভাব পড়বেই। আবার ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছে উচ্চ মুনাফা ও নিশ্চয়তার বিবেচনায়। বেসরকারি খাত ঋণ না পেলে বিকাশ ঘটবে না।
“তাছাড়া ব্যাংক ঋণ পাওয়া যেমন কঠিন, ঠিক তেমনই সুদের হার বেড়েছে। তাতে ব্যবসায় খরচ বাড়ছে। ব্যবসা করতে কস্ট অব ডুয়িং বিজনেসকে বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। তাই ব্যবসা করাও আমাদের জন্য অনেক কঠিন হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমরা সবসময় দাবি করে আসছি, বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য। তবে এটা অনেক কমেছে- যা অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে।
“তাই বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। সুদের হারকেও সহনীয় পর্যায় আনা জরুরি।”
এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “বেসরকারি খাতকে সমৃদ্ধ ও প্রসার করতে হলে ঋণ দেওয়া জরুরি। ঋণ দেওয়া যত সহজ হবে, অর্থনীতি তত বড় হবে। এতে কর্মসংস্থান ও জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়।”
আগের চাইতে এখন যাচাই-বাছাইয়ে যে ব্যাংকগুলো বেশি মনোযোগী হয়েছে তার ইঙ্গিত মিলছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি মাহবুবুর রহমানের কথায়।
তার ভাষ্যে, “কোনো শিল্পগোষ্ঠী ঋণ চাইল, তখন ব্যাংক পর্যালোচনা করে- সেই গ্রুপটির অবস্থা কী রকম।
“মার্কেট ডিমান্ডের ওপর ভিত্তি করে এবং অর্থনীতিকে পর্যালোচনা করেই ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ঋণ দেওয়া বন্ধ নেই, ঋণ দেওয়া হচ্ছে।”
মাহবুবুর রহমান বলেন, “আবার এখন ব্যবসায়ীরা উচ্চ সুদে ঋণ নিতে পারবেন না বলছেন। আমানত ১১ শতাংশ নিলে আড়াই থেকে তিন শতাংশ কস্টেই চলে যায়।
“তাইলে ১ শতাংশ ব্যাংক মুনাফা করতে চাইলে ঋণের সুদের হার ১৫ শতাংশ চলে যায়। তার পরও অনেক ব্যাংক ১৪ শতাংশের মধ্যে সুদ নিচ্ছে।”
ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমার পেছনে ব্যবসায় খরচ বেড়ে যাওয়াকে দুষছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি সামির সাত্তার।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেসরকারি খাতের ঋণ বৃদ্ধির হার কমার অনেক কারণ থাকতে পারে। আমরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি না।
“এর কারণ হল বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর ব্যবসা করার খরচ এখনও বেশি।”
তিনি বলেন, “একদিকে বাজারে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি রয়েছে (যার ফলে মানুষ কম খরচ করছে) এবং অন্যদিকে ঋণ নেওয়ার সুদের হার বেশি; যার ফলে বেশিরভাগ ব্যবসার জন্য সম্প্রসারণে যাওয়া অপ্রীতিকর হয়ে উঠেছে।
“একজন ব্যবসায়ী একটি ব্যবসাকে যদি টেকসই করতে এবং যুক্তিসঙ্গত মুনাফা অর্জন করতে পারে, তাহলে তিনি সম্প্রসারণে যাবেন বা আরও বিনিয়োগের জন্য ঋণ নেবেন।”
ট্রেজারি বিল-বন্ডে সুদহার আরও কমেছে
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি এক দশকে 'সর্বনিম্ন'