চারজনকে তিনটি মামলার আসামি করে আলাদা আলাদা তিনটি অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে।
Published : 24 Jul 2023, 06:46 PM
বছরের শুরুতে স্কুলে জন্ম নিবন্ধন সনদ জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতার সুযোগ নিয়ে সার্ভার বন্ধ থাকার পরও একটি চক্র অবৈধভাবে জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরি করে। এমন ১৮টি জন্ম সনদের বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ ১৭টিরই নাম ঠিকানার কোনো হদিস পায়নি।
দুই বছর আগে চট্টগ্রামের তিনটি ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে অবৈধভাবে জন্ম নিবন্ধন দেওয়ার ঘটনায় তিনটি মামলার তদন্তে এ বিষয়টি উঠে এসেছে।
২০২১ সালের শুরুতে চট্টগ্রাম নগরীর ১৬, ৪০ ও ৪১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ১৮টি ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়ার ঘটনা ধরা পড়ে। যে সময় ওই সনদগুলো দেওয়া হয়েছিল, তখন সফটওয়্যার হালনাগাদের জন্য বন্ধ ছিল জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়া।
এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের জন্ম নিবন্ধন সহকারীরা বাদী হয়ে চকবাজার থানায় একটি ও পতেঙ্গা থানায় আলাদা করে দুটিসহ মোট তিনটি মামলা করেন।
এসব বিষয়ে তদন্ত করে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সাইবার ক্রাইম শাখা। দুই বছরের তদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালতের প্রসিকিউশন শাখায় তিন মামলার অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই স্বপন সরকার।
মামলার আসামিরা হলেন- আশরাফুল আলম, নাজমুল হক আরিফ, খাইরুল ইসলাস রিপন ও খালিদ বিন ইউসুফ।
তাদের মধ্যে আশরাফ ও নাজমুল হক আরিফকে গ্রেপ্তার করা গেলেও খাইরুল ও খালিদকে পলাতক দেখানো হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা স্বপন সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চারজনকেই তিনটি মামলার আসামি করে আলাদা আলাদা তিনটি অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে।
“ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ২২, ২৪, ২৬, ৩৩ ও ৩৪ ধারায় মামলাগুলো করা হয়েছিল। যেহেতু পরস্পরের যোগসাজশের অবৈধভাবে এ জন্ম নিবন্ধগুলো তৈরি করা হয়েছে, তাই ৩৫ ধারাও যুক্ত করা হয়েছে অভিযোগপত্রে।”
তদন্ত কর্মকর্তা এসআই স্বপন বলেন, ১৮টি জন্ম নিবন্ধন সনদের প্রত্যেকটির নাম ঠিকানা ধরে যাচাই বাছাই করেছেন তিনি।
“তার মধ্যে চকবাজার ওয়ার্ডে ইস্যু হওয়া একটি জন্ম নিবন্ধনের স্থায়ী ঠিকানা সঠিক পাওয়া যায়। মূলত সেটিকে ধরে তদন্ত করেই এ চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়।”
যেভাবে চক্রটি শনাক্ত হল
চকবাজার ওয়ার্ড থেকে দেওয়া জন্ম নিবন্ধন সনদগুলোর একটি ইস্যু করা হয় ১২ বছর বয়সী এক শিশুর নামে। যেখানে তার স্থায়ী ঠিকানা দেওয়া হয় কক্সবাজার সদরের ৯ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডের উত্তর পালাকাটা। আর বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করা হয় নগরীর নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাহ রোডের জামিলা হাউস নামে একটি ভবনে।
বর্তমান ঠিকানায় ওই নামের হদিস পাওয়া না গেলেও স্থায়ী ঠিকানায় হদিস পাওয়া যায়। ১২ বছর বয়সী ওই স্কুল ছাত্রের বাবা শেখ মামুন মোর্শেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি জানান, ২০২১ সালের শুরুতে তার সন্তানের স্কুলে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রয়োজন হওয়ায় তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে ছেলের জন্ম নিবন্ধন করতে যান। কিন্তু সনদ ইস্যু বন্ধ থাকায় তা করতে পারেননি।
এ সময় মামুন মোর্শেদ তার পরিচিত মাসুদ রানা নামে একজনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আশরাফুলের নম্বর দেন।
মামুন কথা বলে মাসুদ রানার মাধ্যমে আশরাফুলকে ৭০০ টাকা দেন এবং কিছু দিনের মধ্যে আশরাফুল জন্ম সনদটি মাসুদ রানার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঠিয়ে দেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই স্বপন সরকার জানান, গত বছরের নভেম্বরে যশোরের শার্শা উপজেলা থেকে আশরাফুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আশরাফুল আরও চার জনের নাম বলেন। পরে গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয় নাজমুল হক আরিফকে।
পাশাপাশি কীভাবে এ চক্রের সাথে তিনি জড়িয়েছেন তাও প্রকাশ করেন আশরাফুল।
মাসুদ রানার সাথে যেভাবে পরিচয় আশরাফুলের
কক্সবাজারের জন্মনিবন্ধনের তথ্যসেবা উদ্যোক্তা মাসুদ রানা বর্তমানে ইসলামী ফাউন্ডেশনে চাকরি করেন। জন্ম নিবন্ধন উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করার সময় তার মোবাইল নম্বরটি জন্ম নিবন্ধন অনলাইন সার্ভারে এন্ট্রি করা ছিল।
জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়া বন্ধ থাকায় আশরাফুল অনলাইন সার্ভার থেকে মাসুদ রানার মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাকে ফোন করেন এবং জন্মনিবন্ধন সনদ প্রয়োজন হলে তার সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। অভিযোগপত্রে উদ্যোক্তা মাসুদ রানাকে সাক্ষী করা হয়েছে।
এমএলএম ব্যবসা থেকে জন্ম নিবন্ধন জালিয়াত চক্রে
যশোরের শর্শা উপজেলার বাগআঁচড়া কলেজ রোডে আরিফুলের একটি কম্পিউটার সেবার দোকান আছে। পাশাপাশি তিনি ফরএভার লিভিং প্রোডাক্ট নামে একটি এমএলএম কোম্পানির মালামাল বিক্রি করতেন।
ঢাকায় ওই কোম্পানির এক অনুষ্ঠানে এসে আশরাফুলের সাথে খাইরুল ও নাজমুল হক আরিফের পরিচয় হয়। পরে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করার জন্য আশরাফুলকে প্রস্তাব দেন নাজমুল। এতে রাজি হওয়ায় আশরাফুলকে একটি জন্ম নিবন্ধন সনদের লিঙ্ক পাঠান এবং কীভাবে কাজ করতে হয় তা শিখিয়ে দেন নাজমুল।
পলাতক খাইরুল ইসলাম রিপনের প্রস্তাবেই মূলত আশরাফুল ও নাজমুল অবৈধভাবে জন্ম নিবন্ধন সার্ভারে প্রবেশ করে সনদ ইস্যুর কাজটি শুরু করেন বলে তদন্তে উঠে আসে।
আশরাফুল ও নাজমুল বিভিন্ন জনের তথ্য নিয়ে সেগুলো লিংক খুলে সাবমিট করে খাইরুল ইসলাম রিপনকে জানিয়ে দিতেন। খাইরুল সর্বশেষ ধাপে সাবমিট করে সম্পন্ন হওয়ার কথা জানালে তার কাছে বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিতেন আশরাফুল ও নাজমুল।
তদন্তে উঠে আসে, আশরাফুল জন্ম নিবন্ধন তৈরি করে দেওয়ার কথা বলে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে গ্রাহক সংগ্রহ করতেন। খাইরুল ইসলাম রিপন নাটকে কাজ করায় বিভিন্ন জেলার মানুষের সাথে তার একটি সখ্যতা ছিল।
রিপন জন্ম নিবন্ধন সফটওয়্যারের লিংটি সংগ্রহ করেছিলেন তার পরিচিত খালিদ বিন ইউসুফের কাছ থেকে, যিনি জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের সফটওয়্যার প্রোগ্রামার ছিলেন।
অবৈধ জন্ম নিবন্ধন: তিন মামলায় অভিযোগপত্র চূড়ান্ত, আসামি হচ্ছেন ৪ জন