জরিপের ২১টি এলাকার মধ্যে ২০টিতেই ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ২০ শতাংশের বেশি।
Published : 25 Jul 2023, 10:14 PM
ডেঙ্গুর ভরা মৌসুমে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের ২১টি এলাকার ৩২০টি বাড়ি ও স্থাপনায় জরিপ চালিয়ে উদ্বেগজনক ফলাফল পেয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
এই ২১টি এলাকার মধ্যে ২০টিতেই ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ২০ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ এসব এলাকায় ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এইডিস মশার ঘনত্ব ঝুঁকিপূর্ণ।
জরিপে ৩২০টি বাড়ির মধ্যে ৯৭টি বাড়িতে এইডিস মশা ও লার্ভা শনাক্ত হয়েছে। তাতে হাউজ ইনডেক্স দাঁড়াচ্ছে ৩০ দশমিক ৩১ শতাংশ।
মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয় ব্রুটো ইনডেক্সের মাধ্যমে। জরিপে প্রতি একশ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি এইডিস মশার লার্ভা বা পিউপা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে মশার ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উপস্থিতি বলা যায়।
আর হাউজ ইনডেক্স পাঁচের বেশি হলে তাকে মশার ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উপস্থিতি বিবেচনা করেন বিশেষজ্ঞরা।
জরিপে নেতৃত্বদানকারী জেলা কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদাওস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ শতাংশের উপরে হলে ধরে নিতে হবে ডেঙ্গু বিপজ্জনক মাত্রায় ছড়াচ্ছে। আমরা গড়ে তা পেয়েছি ৪৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।
“তাই ডেঙ্গু ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি। এছাড়া মশার ঘনত্ব বেশি পেয়েছি। গতবছর প্রতি ৫টি বাড়ির মধ্যে ১-২টিতে এইডিস মশার উপস্থিতি মিলেছিল। এবার প্রতি ৫টি বাড়ির মধ্যে ৩-৪টিতেই এইডিস মশা পেয়েছি। দুয়েকটি এলাকায় প্রতিটি বাড়িতেই এইডিস মশা মিলেছে, যেমন- আকবর শাহ এলাকায়।”
জেলায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির পর চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগে ৮ থেকে ২০ জুলাই এই মশক জরিপ চালানো হয়।
নগরীর বহদ্দারহাট, আকবরশাহ-ফিরোজশাহ, বাদামতলী-কর্ণেলহাট, শেরশাহ-বায়েজিদ, হালিশহর, উত্তর ও দক্ষিণ খুলশী, হালিশহর, ষোলশহর-মুরাদপুর, পাঁচলাইশ, উত্তর-দক্ষিণ কাট্টলী, সদরঘাট, হালিশহর, পূর্ব বাকলিয়া, পাহাড়তলী, গোসাইলডাঙ্গা, পাথরঘাটা, আইস ফ্যাক্টরি রোড, হালিশহর বি ব্লক, লাভ লেইন, চকবাজার, বাগমনিরাম ও লালখান বাজার এলাকা ছিল এই জরিপের আওতায়।
জরিপে ভবনের বাইরে-ভিতরে, ছাদে, নির্মাণাধীন ভবনে ও পরিত্যক্ত বিভিন্ন উপকরণেও ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এইডিস মশার লার্ভা মিলেছে।
বাড়ি ও বাড়ির বাইরের বিভিন্ন পরিত্যক্ত জিনিসপত্র মিলিয়ে মশার ৩২০টি সম্ভাব্য প্রজনন স্থানের মধ্যে ১৪৮টিতে মশা বা লার্ভা পাওয়া গেছে।
এছাড়া ৪০০ কন্টেনারে জরিপ চালিয়ে ১৪৮টিতে এইডিস মশা ও লার্ভা পাওয়া গেছে, যার শতকরা হার ৩৭ শতাংশ।
সবচেয়ে বেশি বহদ্দারহাটে
জরিপে নগরীর বহদ্দারহাটের ১৭টি বাড়িতে পরিদর্শন করা হয়। সেখানে বাড়ি ও বাড়ির বাইরে পরিত্যক্ত কন্টেইনার মিলিয়ে এইডিস মশার ২৮টি আবাসস্থল মিলেছে। ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ১৬৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
এছাড়া আকবর শাহ-ফিরোজ শাহ এলাকায় ব্রুটো ইনডেক্সের মান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ৭৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ; বাদামতলি-কর্নেলহাট এলাকায় ৬০ শতাংশ।
ওই ২১ এলাকার মধ্যে সাতটি এলাকাতেই ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ৫০ শতাংশ বা তার বেশি।
সবচেয়ে কম মশার আবাসস্থল মিলেছে লালখান বাজারে। সেখানে ১৫টি স্থাপনা পরিদর্শন করে দুটিতে এইডিস মশা বা লার্ভা মিলেছে। ব্রুটো ইনডেক্সে যা ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদাওস বলেন, বহদ্দরহাট, আকবর শাহ, পাঁচলাইশ ও খুলশী এলাকায় মশার উপস্থিতি বেশি পাওয়া হেছে। লালখান বাজার ও কল্পলোক আবাসিক এলাকার পরিস্থিতি কিছুটা ভালো।
এইডিস এজিপটাই মশা ৭৫%
শহর এলাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণের জন্য দায়ী মূলত এইডিস এজিপটাই প্রজাতির মশা। চট্টগ্রাম নগরীতে চালানো জরিপে এই প্রজাতির মশাই মিলেছে ৭৫ শতাংশ। আর এইডিস এলবোপিকটাস মিলেছে ২৫ শতাংশ।
জরিপে ৭৮৭টি মশা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ৫৯৩টি ছিল এইডিস এজিপটাই প্রজাতির। আর এইডিস এলবোপিকটাস মিলেছে ১৯৪টি।
এনতেজার ফেরদাওস বলেন, “এইডিস এলবোপিকটাস সচরাচর গ্রামে বেশি পাওয়া যায়। এই প্রজাতির মশাও আমরা পেয়েছি ২৫ শতাংশ।”
তিনি বলেন, “৮০ শতাংশ মশাই আমরা পেয়েছি আউটডোরে, মানে বাড়ির বাইরে, নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্টে, ছাদে ফেলে রাখা বিভিন্ন নির্মাণ উপকরণে, বহুতল ভবনের নিচে ফেলে রাখা বিভিন্ন সামগ্রীত, বস্তি এলাকায় ও পরিত্যক্ত জমিতে।
“আর ২০ শতাংশ ভবনের ভিতর যেমন পানির ড্রাম, বালতি ও ফুলের টবসহ বিভিন্ন উপকরণ যেখানে পানি জমে থাকে সেখানে পেয়েছি।”
নগরীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া শিশু শ্রাবন্তী সরকারের পরিবার নগরীর সদরঘাট পোস্ট অফিস গলির যে ভবনে থাকে, সেখানেও গিয়েছিল জরিপকারী দল।
এনতেজার ফেরদাওস জানান, ওই ভবনের নিচে ও ছাদ বাগানে কিংবা ভবনের ভিতর কোথাও তারা এইডিস মশা পাননি। কিন্তু ছাদে রাখা একটি ভাঙা খেলনা প্লাস্টিকের প্লেটে জমে থাকা পানিতে এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়।
জরিপে কন্টেইনার ইনডেক্সে যেসব উপকরণের মধ্যে মশার লার্ভা পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সবার উপরে রয়েছে প্লাস্টিকের কন্টেইনার (২১ দশমিক ৬২%)।
এছাড়া মাটির পাত্র (১৮.৯১%), প্লাস্টিক ড্রাম (১৭.৫৭%), ফুলের টব (৮.১১%) এবং পানির ট্যাংক, ফুলদানি, প্লাস্টিকের ঝুড়ি ও লিফটের গর্তে জমা পানিতে মশার লার্ভা ও ডিম পাওয়া গেছে।
৯ সুপারিশ
এই জরিপের প্রতিবেদন এবং একটি সুপারিশমালা সোমবার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে পাঠায় স্বাস্থ্য বিভাগ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
সুপারিশে বলা হয়েছে- এইডিস মশা পুরোপুরি নিধনের জন্য দিনের বেলা (সূর্যোদয়ের পর থেকে ২ ঘণ্টা ও সূর্যাস্তের আগে ২ ঘণ্টা) ফগিং করা, বছরব্যাপী জরিপ পরিচালনা করে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ ও টায়ারসহ বিভিন্ন পাত্রের পানি অপসারণ করতে হবে।
বাড়িঘরে পাত্র বা উৎসের পানি ৪ থেকে ৫ দিন অন্তর পরিষ্কার করতে হবে। পুরানো টায়ার, যন্ত্রাংশ, কৌটা, প্লাস্টিকের কন্টেইনার, বিভিন্ন পাত্র, নারিকেলের মালা ধ্বংস করতে হবে।
বাসাবাড়িতে আলো প্রবেশ করানো এবং জানালার পর্দা, টেবিল চেয়ারের নিচে পরিষ্কার রাখা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ প্রত্যেক স্থাপনায় দরজা জানালার পর্দা পাইরোথ্রোয়েত জাতীয় কীটনাশক দিয়ে চুবিয়ে নেওয়া। জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে লক্ষ্যে নিয়মিত মাইকিং, লিফলেট বা পোস্টার বিতরণ এবং কাউন্সিলিং করার কথাও বলা হয়েছে সুপারিশে।
চট্টগ্রাম জেলায় চলতি জুলাই মাসের ২৪ দিনে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৭৭৬ জন।এর মধ্যে নগরীর বাসিন্দা ১৩০৯ জন।
শেষ ২৪ ঘণ্টায় আরো একজন শিশু ডেঙ্গুতে মারা গেছে। কক্সবাজার জেলার উখিয়ার মরিয়ম নামের ৯ বছর বয়সী শিশুটি সোমবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে মারা যায়।
এবছর জেলায় ডেঙ্গুতে ২৩ জন মারা গেছে, তাদের ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে চলতি জুলাই মাসে।
মৃতদের মধ্যে ১২ জনই শিশু, ৬ জন পুরুষ ও ৫জন নারী। চলতি বছর জেলায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ২২৪১ জনের।