মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক বলছেন, “নাম সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় মানে এই নয় যে, সেখানে শুধু মুসলিম শিক্ষার্থীরাই পড়বেন।”
Published : 12 Dec 2023, 01:02 AM
চট্টগ্রামের সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ে ‘অমুসলিম ছাত্রদের’ ভর্তি লটারিতে অন্তর্ভুক্ত না করার অনুরোধ জানিয়ে একটি ব্যানার দেওয়ার পর তা নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে।
শতবর্ষী এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে শনিবার দিনের কোনো এক সময় ওই ব্যানার লাগানো হয়।
ওই ব্যানার লাগানো এবং কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ নেওয়ায় তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় ডেকেছে পুলিশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ে অমুসলিম ছাত্র ভর্তি হতে পারবে না, এরকম কোনো বিধি নিষেধ নেই। তবে প্রায় শতবর্ষী এই প্রতিষ্ঠানে গত বছরই প্রথম লটারির মাধ্যমে অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন।
রাতের বেলা স্কুলের দেয়ালে টাঙানো ব্যানারের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ‘সম্মিলিত অভিভাবক ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর নামে ওই ব্যানারটি লাগানো হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেখানে লেখা হয়েছে, “চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সরকারী মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের ভর্তি লটারিতে অমুসলিম ছাত্রদের অংশগ্রহণের অর্ন্তভুক্ত না দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় শুধুমাত্র মুসলিম ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত একটি প্রতিষ্ঠান।”
শনিবার ওই ব্যানার টানানোর পর রোববার সকালে ও বিকেলে গিয়ে সেখানে ব্যানারটি আর দেখা যায়নি।
নগরীর কোতোয়ালি থানার সীমানা দেয়ালের সাথে লাগানো সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর। চট্টগ্রাম আদালত ভবনের প্রবশের পথের ঠিক বিপরীত পাশেই এ স্কুলের মূল ফটক।
এই স্কুলের যাত্রা শুরু হয় একশ বছরের বেশি সময় আগে, হাজী মুহাম্মদ মহসীনের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ফান্ডের টাকায়। শুরুতে এটি চট্টগ্রাম মহসিনিয়া মাদ্রাসা নামে যাত্রা শুরু করে। পরে হাজী মুহাম্মদ মহসিন উচ্চ বিদ্যালয় ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ নামের দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়।
এক সময় ইসলাম ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ায় স্থানীয় মুসলিম নেতাদের উদ্যোগে স্কুলের ‘অ্যাংলো-পার্সিয়ান ডিপার্টমেন্ট’ হিসেবে (এখানে ইংরেজি ও ফার্সি ভাষা পড়ানো হত) মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়।
সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, “খুব কম সময়ের ব্যাবধানে এ ডিপার্টমেন্টের ছাত্র সংখ্যা বাড়তে থাকলে প্রয়োজনের তাগিদে এ ডিপার্টমেন্টটি রেজিস্ট্রেশান ভবনে অর্থাৎ বিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত হয় ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে।
“স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের দাবি ও চেষ্টার ফলে উক্ত ডিপার্টমেন্টটি ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে গভ মুসলিম হাই স্কুল নামে বর্তমান জায়গায় পর্তুগিজ আমলে নির্মিত পুরাতন দ্বিতল ভবনে স্থানান্তরিত হয় পুর্নাঙ্গ স্কুলের স্বাধীন সত্তা নিয়ে।”
ওয়েবসাইটে লেখা আছে, “বিদ্যালয়ের স্বাধীন গভর্নিং বডি গঠিত হয় ১৯১৬ সালে। উল্লেখ থাকে যে, বাংলাদেশের দক্ষিণ পুর্বাঞ্চলে এটাই একমাত্র স্কুল যা স্থাপিত হয়েছিল কেবল মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষা লাভের জন্য।
“অবকাঠামোগত দিক দিয়ে স্কুলটি আকর্ষণীয় না হলেও গুণগত, আদর্শ ও কৃষ্টিগতভাবে এটি ছিল তৎকালীন মুসলিম পরিবারের মেধাবী ও প্রতিভাবান ছাত্রদের আকর্ষণীয় শিক্ষালয়। সেই সময়ে এই স্কুলকে মনে করা হত মুসলিম ঐতিহ্য ও তমদ্দুনের প্রতীক হিসেবে।”
দেশ ভাগের পর ভারত থেকে আসা উর্দুভাষী মুসলিম, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা বাহিনীর পোষ্যদের প্রয়োজনে এই স্কুলে ১৯৫১ সালে উর্দু শাখা খোলা হয়।
পরে মুসলিম হাইস্কুল সরকারি করা হয়। তবে আগের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে সেখানে কোনো অমুসলিম ছাত্র ভর্তি করা হত না।
সরকারি স্কুলে ভর্তিতে লটারি পদ্ধতি চালু হলে ২০২২ সালে এই স্কুলে কয়েকজন অমুসলিম শিক্ষার্থী ভর্তি হয়।
দেয়ালে ব্যানার লাগিয়ে অমুসলিম ছাত্র ভর্তি না করানোর আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মমতাজ আকতার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শনিবার স্কুল বন্ধ ছিল। রবিবার আমরা স্কুলে এসে এরকম কোনো ব্যানার দেখতে পাইনি।”
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যানারের ছবি ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে পুলিশ খোঁজ নিতে শুরু করে। পরে সোমবার দুপুরে এ ঘটনায় জিজ্ঞাসবাদের জন্য তিনজনকে কোতোয়ালি থানায় নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “কিছু সাবেক ছাত্র ও অভিভাবক স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যানারটি লাগিয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি। তাদের মধ্যে আমরা রাশেদুল আলম নামের একজনসহ তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় এনেছি। তাদের কি উদ্দেশ্য, সেটি জানার জন্য তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।”
পুলিশের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, যারা ব্যানার টাঙিয়েছিলেন, তারা এ বিষয়ে সোমবার একটি মানববন্ধনও করতে চেয়েছিলেন। সেটার আয়োজক কথিত যুবলীগ নেতা রাশেদুল আলম। বিষয়টি জানতে পেরে তাকে থানায় ডেকে নেওয়া হয়।
ব্যানার লাগানোর বিষয়ে জানতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে রাশেদুল আলমের মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক রেজাউল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো ধর্মের শিক্ষার্থী ভর্তিতে কোনো ধরনের বিধি নিষেধ নেই। সরকারি নীতিমালা অনুসারে সরকারি স্কুলে সব ধর্মের-জাতির-বর্ণের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার সুযোগ পাবে। সবার জন্য উন্মুক্ত।
“নাম সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় মানে এই নয় যে, সেখানে শুধু মুসলিম শিক্ষার্থীরাই পড়বেন।”
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক বিপ্লব গাঙ্গুলী বলেন, “কোনো ধর্মের শিক্ষার্থী ভর্তিতে কোনো সরকারি স্কুলে কোনো বিধিনিষেধ নেই। সুযোগ পেলে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার অধিকার সবার আছে।”
এ বিষয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুসলিম হাই স্কুল একটি সরকারি বিদ্যালয়। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি নীতিমালা অনুসারে ভর্তি কার্যক্রম হবে। গত বছর সেখানে কয়েকজন অমুসলিম শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল।
“আগে হয়নি বলে এখনও হবে না, তেমনটা হতে পারে না। সরকারি স্কুলে সুযোগ পেলে পড়ার অধিকার সবার সমান।”
সোমবার বিকেলে নিজের ফেইসবুক পেইজে এক পোস্টে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল লেখেন, “সরকারি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী ভর্তি কার্যক্রম হবে। নির্ধারিত কোটা, মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী ইত্যাদি, ব্যতীত, কোনো ধর্মের অনুসারী, ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর ক্ষেত্রে ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য করার সুযোগ নেই।
“চট্টগ্রামে একটি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু ব্যক্তি সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক ব্যানার দিয়ে যে দাবি করেছেন, সেটি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক এবং বেআইনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা নিয়ে, সকল ধর্মের শিক্ষার্থীদের জন্য (মাদ্রাসা ব্যতীত) সকল সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহে, ভর্তির সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে বদ্ধ পরিকর এবং আইনত বাধ্য।”
এ বিষয়কে কেন্দ্র করে যারা ‘ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম করার অপচেষ্টা’ করবেন, তাদের ব্যাপারে প্রশাসন ‘যথাযথ ব্যবস্থা’ নেবে বলেও হুঁশিয়র করেন নওফেল।