কর্ণফুলী ড্রাইডকের নির্মাণ কাজ বন্ধের নির্দেশ

এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে সাত দিনের মধ্যে নদী রক্ষা কমিশনে প্রতিবেদন জমা দিতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2022, 07:49 AM
Updated : 9 Nov 2022, 07:49 AM

চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কর্ণফুলী নদীর তীরে নির্মাণাধীন কর্ণফুলী ড্রাইডক লিমিটেডসহ আশপাশের সকল স্থাপনার কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী।

এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে সাত দিনের মধ্যে নদী রক্ষা কমিশনে প্রতিবেদন জমা দিতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

বুধবার চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ‘চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীসহ অন্যান্য নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় ও জলাধার এর দখল ও দূষণ’ সংক্রান্ত এক পর্যালোচনা সভা শেষে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের এ নির্দেশনা আসে।

তিনি বলেন, “কর্ণফুলী ড্রাইডকের বিষয়ে একটি বিশেষজ্ঞ টিম করা হবে। সেই টিম নির্ধারণ করবে সেখানে কী হয়েছে এবং কীভাবে নদী উদ্ধার করা হবে। ততদিন কাজ বন্ধ থাকবে।”

Also Read: কর্ণফুলীর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান

আনোয়ারার বদলাপুর মৌজায় বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া এবং ব্যক্তি মালিকানা থেকে কেনা ৩০ একর জমিতে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হচ্ছে কর্ণফুলী ড্রাইডক।

মঙ্গলবার কর্ণফুলী নদীর আনোয়ারা সংলগ্ন কর্ণফুলী ড্রাইডক লিমিটেড, পতেঙ্গা ও তৃতীয় সেতু অংশ পরিদর্শন শেষে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান নদী দখল নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

বুধবার তার সঙ্গে সভায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং কর্ণফুলী ড্রাইডক লিমিটেডের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

কর্ণফুলী ড্রাইডক লিমিটেডের কর্মকর্তা মো. সোহরাব হোসেন সভায় বলেন, “আমাদের প্রতিষ্ঠান অকৃষি খাস জমিতে। এটা নদীর জমি নয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে আমরা জমি লিজ নিয়েছি। বন্দরের কাছ থেকেও লিজ নিয়েছি।

“চট্টগ্রাম বন্দর এবং আমরা মিলে বুয়েটের এর শিক্ষককে দিয়ে ডিটেইল রিপোর্ট করেছি। আপনি গণমাধ্যমে বলেছেন, কর্ণফুলী ড্রাইডক নদীর জমিতে। এতে প্রতিষ্ঠানের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমাদের সকল স্থাপনা নিজেদের কেনা জমিতে। শুধু দুটি জেটি বন্দরের জমিতে হচ্ছে। এই প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন আছে। বেজা, বিনিয়োগ বোর্ডসহ সকল সরকারি দপ্তর এই প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে।”

নদী রক্ষা কমিশনের উপপরিচালক (গবেষণা ও নিরীক্ষণ) আকতারুজ্জামান তালুকদার এ সময় বলেন, “বদলপুরা মৌজায় যে চারটি দাগে আপনাদের জমি সেগুলো অকৃষি নয়। আমাদের কাছে কাগজপত্র আছে। এগুলো খিলা ও চর ভূমি।”

চট্টগ্রাম বন্দরের সিনিয়র হাইড্রোগ্রাফার মো. নাসির ‍উদ্দিন সভায় বলেন, “মোহনা থেকে ১৬ কিলোমিটার ভিতরে বন্দর। এই পুরো এলাকায় যে কোনো জেটি নির্মাণে আমরা বন্দরের স্বার্থ দেখে অনুমতি দিই।

“এক্ষেত্রে দেখা হয় অন্য সরকারি সংস্থার অনুমতি আছে কিনা। তাদের নিজস্ব জমি আছে কিনা। কর্ণফুলী ড্রাইডক অনুমতি চাইলে তখন আমরা নদীর প্রবাহ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাস। বুয়েটকে দিয়ে তারা একটি প্রতিবেদন করায়। সেটা ড্রাইং এরিয়া- জোয়ারে পানি আসে, পরে শুকিয়ে আছে।”

নাসির বলেন, ওই অংশের দূরত্ব তীর থেকে ৬৬৬ মিটার। ট্রানজিট লাইন থেকে ১২০ মিটার দূরে। নেভিগেশন ও নদীর গতিপথে কোনো সমস্যা হবে না– এসব দেখেই অনুমতি দেয়া হয়।

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান তখন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আইন অনুসারে কোনো ডক নির্মাণে কোথায় অনুমতি দেওয়া যাবে, তা নির্ধারিত। আর সেটা হল ‘হাই ওয়াটার মার্কের’ নিচে।

“তাদের (কর্ণফুলী ড্রাইডক) সীমানা হাই ওয়াটার মার্কের উপরে। এ বিষয়ে হাই কোর্টের রায়ও আছে। ফোরশোর (নদী তীর) ও রিভার বেড মিলেই নদী। নদী তীর কোনোভাবে একসনার (এক বছর) বেশি লিজ দেওয়া যাবে না।”

মঙ্গলবার চাক্তাই ভেড়া মার্কেটের বিপরীতে জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠিত নতুন ফিশারি ঘাট এলাকা ঘুরে দেখে সেখানে নদী দখল নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান।

বুধবারের সভায় ফিশারিঘাট এলাকায় নদীর জমি লিজ দেওয়ার ব্যাখ্যায় বন্দরের সিনিয়র হাইড্রোগ্রাফার নাসির বলেন, “চাক্তাই-রাজাখালী অংশে নদী ৮১৫-৮৪০ মিটার। এতে নদীর স্রোত ও গতিধারায় কোনো ক্ষতি হবে না। এখানে নদী ড্রেজিং করে দুই মাসও রাখা যায় না। ভরাট হয়ে যায় মাটি জমে।

“ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর সময় ২০১১ সালে ফিশারিঘাটের ওই অংশটি যা মূলত জেগে ওটা চর, বুয়েটের ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একটি দল স্টাডি করে দেখেছে। তারাই ড্রেজিং করে ব্যাংক প্রোটেকশন (তীর সুরক্ষা) করতে বলেছে। তারপর তা করা হয়েছে। তারপর লিজ দেওয়া হয়।”

নদী কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, “সিএস অনুসারে নদী পাবলিক ট্রাস্ট প্রপার্টি। এটা রক্ষা করবে জেলা প্রশাসন। আপনারা লিজ দেয়ার কে? নদীর জমিতে স্ট্রাকচার অবৈধ।

“শুধু সেখানে নয়, পাশের মেরিনার পার্ক, বোট ক্লাব, ইনকনট্রেড, লালদিয়ার চর যেখানে আপনারা (বন্দর) বালি ফেলে ভরাট করে রেখেছেন এবং ভেড়া মার্কেটের বিপরীতে ফিশারিঘাট– সবই নদীর জমিতে। একসময় নদী প্রস্থে তিন কিলোমিটার ছিল এখন শুধু ৫০০ মিটার আছে।”

মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, “এখন কেউ কেউ বারবার বলছেন কর্ণফুলী নদীতে দুটি জাহাজ চলাচল করতে পারে। পরে বলবেন, শুধু একটি জাহাজ যায় তো। বহু বড় প্রতিষ্ঠান নদীর জমি দখল করে প্রতিষ্ঠান করছেন, আরও দখলের চেষ্টা করছেন।

“আমি আবার বলব, বিদ্যমান আইন পর্যালোচনা করে বলছি, কর্ণফুলী ড্রাইডকের টোটাল স্থাপনা নদীর মধ্যে। এটা অবিলম্বে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। একই ঘটনা ফিশারিঘাটের বেলায়। সেটা আদৌ দরকার আছে কিনা দেখা হবে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে। তারপর মানবিকভাবে তাদের সরিয়ে নেওয়া হবে।”

হাই কোর্টের নির্দেশে কর্ণফুলীর তীরে থাকা প্রায় দুই হাজার একশর বেশি স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে জানতে চাইলে নদী কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, “এটা কনটিউনিয়াস প্রসেস। সব সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার প্রতিনিধি দিয়ে কমিটি করে দেওয়া হবে। তারা ঠিক করবে কোথায় কখন কীভাবে উচ্ছেদ চালানো হবে।”

সভার সভাপতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, ইতোপূর্বে কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে ব্যয় হওয়া অর্থের সংস্থান এখনো হয়নি। নদীতে উচ্ছেদ কঠিন ও ব্যয়বহুল। কমিটি নির্দেশনা দিলে তারা কাজ শুরু করবেন।