নোটিস দিয়ে সতর্ক করা হলেও হেলদোল নেই ব্যবসায়ীদের-সেটা হকার্স মার্কেট বা রেয়াজউদ্দিন বাজার, যেটাই হোক ভাষ্য প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের।
Published : 07 Apr 2023, 08:57 AM
পাহাড়ের ওপরে সরু গলির দুপাশে অগুণিত দোকান আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত শত কাপড়ের গুদাম ঘরের জহুর হকার্স মার্কেটে সকাল থেকে রাত অবধি ক্রেতা-বিক্রেতাদের হৈহল্লা নিত্যকার পরিচিত চিত্র।
চট্টগ্রামের সীমিত আয়ের মানুষ ও শৌখিন কাপড় ক্রেতাদের অনেকের পছন্দের কেনাকাটার এ জায়গার উল্টো দিকেই শতাধিক পণ্যের ছোট ছোট মার্কেটের আরেক বিপণি কেন্দ্র; যেখানে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে গড়ে ওঠা দোকানের পরিমাণও কয়েক হাজার। নিচ তলায় দোকান, উপরে গুদাম, বাসা, খাবার ও আবাসিক হোটেলের রেয়াজউদ্দিন বাজার এক ঘিঞ্জি ব্যবসা কেন্দ্র; যেখানে পৌঁছে না দিনের আলো।
নগরীর এ দুই ব্যস্ততম ব্যবসা কেন্দ্রের এমন চিত্র সবাই দেখে আসছেন যুগের পর যুগ থেকে। মাঝেমধ্যে ছোটখাট দুর্ঘটনার পর নানান ঝুঁকির বিষয় সামনে এলেও অবকাঠামো বদলের সেই আলোচনা কদিন পরই যায় তলিয়ে।
অনেকটা জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠা এ দু্ই বিপণি কেন্দ্রে নেই পর্যাপ্ত রাস্তা, পানির উৎস বা নিজস্ব অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা।
শুধু এ দুটি নয়, চট্টগ্রাম নগরীর বড় পাইকারি কাপড় কেনাবেচার কেন্দ্র টেরিবাজার, ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও আসাদগঞ্জের চিত্রও প্রায় একই; নেই আগুন কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনার ঝুঁকি মোকাবিলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।
বিভিন্ন সময়ে প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নোটিস দিয়ে ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা হলেও তা নিয়ে উদ্যোগও নেই তাদের।
সরু সড়ক, পানির ব্যবস্থা না থাকার মত নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যে আগুনসহ বিভিন্ন ঝুঁকি চিহ্নিত করা এবং সমাধানে করণীয় খুঁজতে এসব বিপণি ও ব্যবসাকেন্দ্রকে নতুন করে জরিপের আওতায় আনার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক এমডি আব্দুল মালেক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, ২০২২ সালের জুনে বিএম কন্টেইনার ডিপোর অগ্নিকাণ্ডের পর খাত অনুযায়ী ঝুঁকি চিহ্নিত করতে পরিদর্শন দল গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। বিভিন্ন স্থাপনা ও বিপণি বিতানগুলো পরিদর্শন করে নতুন করে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে কয়েকটি খাতের পরিদর্শন শেষ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন মার্কেট পরিদর্শনের কাজ চলছে। পরির্দশনের প্রতিবেদন জেলা প্রশাসন ও সদর দপ্তরে সুপারিশসহ পাঠানো হবে।
চট্টগ্রামের জহুর হকার্স মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড
এর আগে ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে রেয়াজউদ্দিন বাজার, টেরিবাজারসহ নগরীর ৪২টি বিপণি বিতান ও ব্যবসাকেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শেষে এনডিসি তৌহিদুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, হকার্স মার্কেটের অন্তত এক হাজার ২০০ দোকান অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। কোনো দোকানেই নেই আগুন নেভানোর ব্যবস্থা, বৈদ্যুতিক লাইনগুলোও রয়েছে বিপজ্জনকভাবে।
সেখানে আগুন লাগার ঘটনায় গঠিত একটি তদন্ত কমিটি পানি মজুদের ব্যবস্থা করতে বললেও তা হয়নি বলে জানান তিনি।
ঝুঁকি মানছেন ব্যবসায়ীরা তবুও উদ্যোগহীন
নগরীর সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র রেয়াজউদ্দিন বাজার গড়ে উঠেছে কয়েক বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকা জুড়ে; যেখানে রয়েছে ছোট বড় শতাধিক মার্কেট, যেগুলো একটি লাগোয়া আরেকটির সঙ্গে।
সবজি, কাপড়, জুতা, কসমেটিকস, ইলেকট্রনিক্স, মোবাইল, ফলমূলসহ কী নেই চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় এ বাজারে। রয়েছে বেশকিছু খাবারের দোকান, যেখানে সিলিন্ডার গ্যাসে হয় রান্না।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা মালেক রেয়াজউদ্দিন বাজারের বড় সমস্যা হিসেবে নিচ তলার দোকানের উপরে গুদামকে চিহ্নিত করেন। তারা দেখেছেন, সেখানে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বৈদ্যুতিক, টেলিফোন, ইন্টারনেট ও ডিশ লাইনের তার। বৈদ্যুতিক সংযোগুলোতে রয়েছে ‘লুজ ওয়ারিং’।
এখানকার তামাকুমণ্ডি লেইনে গড়ে উঠা ভবনগুলোর কোনটিতেই মানা হয়নি বিল্ডিং কোড। পর্যপ্ত জায়গা রাখা এবং অগ্নি নির্বাপনের কোন ব্যবস্থাও নেই।
রেয়াজউদ্দিন ও টেরিবাজারের আগের আগুন লাগার অভিজ্ঞতা থেকে ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আগুনের খবরে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা দ্রুত পৌঁছাতে পারলেও কাজ করতে বেগ পেতে হবে। এত সরু রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়ি প্রবেশ করানো যায় না। পর্যাপ্ত পানিও নেই সেখানে। বিভিন্ন সময়ে মার্কেটের সমিতিগুলোকে তাগদা দেওয়া হলেও তারা তাতে মনোযোগী নন।
সহকারী পরিচালক মালেক বলেন, সাম্প্রতিক সময়েও বৈঠকে আবার অগ্নিঝুঁকির বিষয়টি তাদের জানানো হয়েছে। অনুরোধ করা হয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ডে পানির ‘রিজার্ভার’ স্থাপনের।
রেয়াজউদ্দিন বাজারের অগ্নিঝুঁকির বিষয়টি মানছেন ব্যবসায়ীরাও। নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন বলেন, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এখানে গড়ে উঠেছে একের পর এক মার্কেট।
তামাকমুণ্ডি লেইন, নুপুর মার্কেট এলাকাসহ রেয়াজউদ্দিন বাজারের সব মার্কেটের দোকানদার ও কর্মচারীর সংখ্যা ১০ হাজারের মতো। প্রতিদিন কয়েক লাখ লোকের সমাগম হয় সেখানে। দিনের বেলা বড় কোনো দুর্ঘটনা ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে বলেও শঙ্কা তাদের।
এটির মতো অবস্থা পাইকারি কাপড়ের বাজার টেরিবাজারেরও, যেখানে সরু রাস্তায় দুপাশে শত শত ছোট ভবনে রয়েছে হাজার খানেক দোকান। এখানেও দোকান ও ভবনের উপরে গুদাম করে ঝুঁকি বাড়ানো হয়েছে।
গত ১১ মার্চ রেয়াজউদ্দিন বাজার ও ১৯ মার্চ টেরিবাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তামূলক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মালেক বলেন, বিভিন্ন ধরনের তার অপসারণেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ভবন বা দোকানের উপর গুদাম সরাতেও বলা হয়েছে। একই সঙ্গে গুদামে রাত্রিযাপন না করা এবং রান্না থেকে বিরত থাকতে নজর দিতে অনুরোধ করা হয়েছে।