“এই গামারি গাছগুলোও মহিউদ্দিন ভাইয়ের হাতে লাগানো। তিনি চাইতেন, পথ শিশুরা এইসব ফলদ গাছের ফল খাবে,” বলছিলেন জহরলাল হাজারী।
Published : 13 Mar 2024, 07:30 AM
ফাল্গুনে লাল শিমুল আর কমলা পলাশের আগুন যখন সবার নজর কেড়ে নেয়, তখন অনেকটা অলখে ফুটে ঝরে যায় বসন্তের আরেক ফুল হলুদ বরণ- গামারি।
শীতের শেষে গামারি গাছ একেবারে পাতাহীন হয়ে যায়। বসন্তের শুরুতে দুয়েকটি ডালে থাকে সবুজ কচি পাতা; আর গাছ ভর্তি ফুল।
শেষ বিকেলের আলোয় গামারির ডালে হলুদ আর লালচে বাদামি ফুলের বাহার যেন এক সোনালি-সবুজ নকশিকাঁথা।
সন্ধ্যার পর টুপটাপ করে ঝরতে শুরু করে ফুলগুলো। ভোরের দিকে সবুজ ঘাসের উপর ফুলের হলুদ ও লালচে বাদামি রঙ তৈরি করে বর্ণিল গালিচা।
শহরে এই দৃশ্য অতি বিরল। গামারি গাছের দেখাই মেলে হঠাৎ। আর দালানে ঘেরা শহরে সবুজ ঘাস তো রীতিমত খুঁজতে হয়। তবু কখনো কখনো রচিত হয় এমন দৃশ্য।
সন্ধ্যার পর বন্দর নগরীর জেল রোড ধরে লালদীঘি পার্কের পশ্চিম পাড়ে আসতেই একটা সাদা রঙের গাড়ির বনেটে কয়েকটা ঝরে পড়া ফুল চোখে পড়ল। প্রায় অন্ধকার জায়গাটায় একটু দাঁড়াতেই চোখে পড়ল, পার্কের ভেতরে থাকা একটি গাছ থেকে ফুল ঝরে পড়ছে রাস্তায়।
অন্ধকারে পারুল ফুল ভেবে ভুল হল। কয়েকটা ফুল কুড়িয়ে নিতেই মিলল হালকা সুবাস। ওই গাড়ির চালক জানালেন, এই গাছের ফুল বেশিরভাগ পড়ে যায়। এখানে পার্কের ফুটপাতে যারা থাকে, তারা কুড়িয়ে নিয়ে বিক্রিও করে।
আলোতে এসে ভালো করে দেখতেই বোঝা গেল, পারুল নয়, এগুলো গামারির ফুল। কয়েক গজ আসার পর পার্কের ভেতর থাকা আরো একটি গাছের দেখা মিলল। এই গাছটি আকারে বেশ বড়। তবে ফুল তুলনামূলক কম।
এ অঞ্চলে আদিনিবাস হলেও শহরে গামারির দেখা তেমন মেলে না। তবু লালদীঘি পার্কে দুটো বড় গামারি গাছ কীভাবে বেড়ে উঠল?
সেই প্রশ্নের উত্তরে আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “লালদীঘি ঘিরে প্রথম বাগান করেছিলেন এই অঞ্চলের জমিদার রায় বাহাদুর রাজকুমার ঘোষ। বহুবছর অবহেলিত অবস্থায় বাগানটি পড়ে ছিল।
“পরে সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এটিকে পার্ক করার উদ্যোগ নেন। তিনি দীঘিটি সংস্কার করেন। এর চারপাশ ঘিরে বিভিন্ন ফলদ ও বনজ গাছ লাগান। পার্কে এখন আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, আমলকি, শিরিষ, সেগুন, কাঁঠাল চাপা, কাঠ গোলাপ, দেবদারু, বিদেশি জাতের পাম ও পাতাবাহারসহ বিভিন্ন রকম গাছ আছে।”
জহরলাল হাজারী বলেন, “এই গামারি গাছগুলোও মহিউদ্দিন ভাইয়ের হাতে লাগানো। তিনি চাইতেন, পথ শিশুরা ওইসব ফলদ গাছের ফল খাবে। গত ২০ বছরে গাছগুলো অনেক বড় হয়েছে।
“এখন দীঘির চারপাশের গাছগুলো সুন্দর ছায়া দেয়। সকালে ও বিকেলে অনেক মানুষ এই ছায়াঘেরা পথে হাঁটে।”
পার্কের ঠিক পশ্চিম পাড়ে কয়েকটা পাম ও একটি খেজুর গাছের মাঝে মাঝারি আকারের গামারি গাছটি ফুলে ফুলে ভরা। আর দক্ষিণ পশ্চিম কোণের বিশাল গাছটি প্রায় চার তলা ভবনের সমান উঁচু। সেটিতেও ফুল ফুটেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক রাসেল বলেন, “আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকেই বহুল পরিচিত উদ্ভিদ গামারি। গামারি মূলত ভারতবর্ষের গাছ। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, কম্বোডিয়া, জাপান, লাওস, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ গ্রীষ্ম প্রধান দেশগুলোতে এই গাছ জন্মায়।
অঞ্চলভেদে গামারি গাছের নানা নাম। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সুভদ্রা, কম্ভারী, কাশ্মিরী, মধুমতী, গামার, গাম্বার ও ভ্রমরপ্রিয়া। ইংরেজিতে Malay beechwood, Kashmir tree, Candahar tree, beechwood, Goomar teak, Gmelina ইত্যাদি নামে পরিচিত।
গামারির বৈজ্ঞানিক নাম- Gmelina arborea Roxb. ex Sm. এটি Lamiaceae পরিবারভুক্ত মাঝারি গড়নের একটি উদ্ভিদ।
দ্রুত বর্ধনশীল এই গাছ লম্বায় ১৫ থেকে ৩০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়।
গামারির ফুল দেখতে বেশ ব্যতিক্রমী। পাঁচটি পাপড়ি থাকলেও মাঝের পাপড়িটি অন্যগুলোর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ নম্বা। বড় পাপড়িটির লম্বা মুকুটের মত অংশটি গাঢ় হলুদ। ফুলের গোড়ার দিকে হলুদ রঙের পাশাপাশি দেখা মেলে লালচে-বাদামি ও খয়েরি রঙের।
ড. রাসেল বলেন, “গামারি ফুলে বেশ মধু হয় বলে ভ্রমরের কাছে এই ফুলের আকর্ষণ প্রচুর। বসন্তে যখন পত্রহীন গাছ ফুলে ভরে ওঠে, তখন ভ্রমরের ঝাঁক ছুটে আসে মধু খেতে। সে কারণে গামারি ভ্রমরপ্রিয়া নামেও পরিচিত।
“ভ্রমরের পাশাপাশি টিয়া, শালিক ও কাঠবিড়ালেরও খুব পছন্দ গামারির ফুল। এ গাছের ফল গোলাকার ও শাঁসযুক্ত। সবুজ রঙের ফলের উপর হালকা হলুদ ফুটকি আছে। এ গাছের পাতা অনেকটা পান পাতার আকৃতির।”
আসবাবপত্র তৈরিতে সেগুনের পরেই গামারি কাঠের প্রাধান্য। ঘরের সরঞ্জাম, নৌকা ও ঢোলের খোল বানাতে গামারি গাছের বেশ চাহিদা আছে।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক রাসেল বলেন, কাগজ তৈরিতে পাল্পের কাঁচামাল হিসেবে গামারি ব্যাপক ব্যবহার হত। সেকারণে এক সময় কর্ণফুলী পেপারমিল সংলগ্ন কাপ্তাইয়ের বিভিন্ন এলাকাতে এবং রাঙামাটিতেও এর বাণিজ্যিক চাষ হয়েছিল।
“বিভিন্ন সময় পত্রিকায় ওই এলাকা থেকে পাচারের সময় গামারি কাঠ উদ্ধারের খবর প্রকাশ হত। এখন সেখানেও গামারি গাছ অনেক কমে গেছে।”
কেবল ফুল বা কাঠ নয়, গামারির প্রায় সব অংশেরই ব্যবহার আছে। গামারি একটি ভেষজ গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ। এর পাতার রস জীবাণুনাশক। ফল ও ছাল পিত্ত জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহার হয়।
রক্ত আমাশয়ের জন্য এ গাছের ফলের রসের সঙ্গে ডালিমের রস মিশিয়ে সেবন করা হয়। গাছের শেঁকড় কৃমিনাশক এবং কুষ্ঠরোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হয়।
গামারির পাতা ও ফল পশু-পাখিরও খাদ্য। জ্বালানি কাঠ হিসেবেও গামারি উপযোগী।
এত গুণ যেই গামারির, তা অনেকটা নীরবেই টিকে আছে নাগরিক জঞ্জালের মধ্যে । নিয়ম করে বসন্তে ফুল-ফল দিচ্ছে। ফুলের গন্ধে ভ্রমর ভিড় জমাচ্ছে। ফলের লোভে আসছে পাখিরাও।
শেষ বিকেলের আলোয় সোনালি সবুজ নকশা মনে করিয়ে দিচ্ছে, প্রকৃতিতে বসন্ত তার সমস্ত আয়োজন নিয়ে হাজির।
লালদীঘি পার্কে হাঁটতে আসা মানুষের মাঝে গামারি ফুলের মাদকতা ছড়ানো সৌরভ সেই আয়োজনেরই রেশ হয়ে ছড়িয়ে আছে।