এই পাঁচজনের মধ্যে তিনজনকে নৌকার প্রার্থীর মোকাবেলা করতে হবে।
Published : 25 Dec 2023, 08:26 AM
এবারের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চট্টগ্রামের পাঁচ উপজেলা চেয়ারম্যান পদ ছেড়েছেন, যাদের মধ্যে দুজন লড়ছেন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে। আর দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে ভোটের মাঠে আছেন বাকি তিনপ্রার্থী। তবে এই তিনজনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী।
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড উপজেলা ও নগরীর ৯ ও ১০ নম্বর ওয়ার্ড) আসনে এস এম আল মামুন ও চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া উপজেলা) আসনে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
এ দুই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে ‘ফুরফুরে মেজাজে’ আছেন আল মামুন। তার আসনে আট জন প্রার্থী থাকলেও তারা মামুনের সঙ্গে পেরে উঠবেন না বলেই স্থানীয়দের ধারণা।
মামুন দুই দফা সীতাকুণ্ডের উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন, তার বাবা প্রয়াত এ বি এম আবুল কাশেম মাস্টার ছিলেন এ আসনের দুই বারের সংসদ সদস্য। ফলে আগে থেকেই এলাকায় প্রভাব প্রতিপত্তি আছে মামুনের।
এ আসনের বর্তমান এমপি দিদারুল আলম দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না।
সীতাকুণ্ডের স্থানীয় রাজনীতিতে সংসদ সদস্য দিদারুল আলম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বাকের ভূঁইয়া এবং মামুনের মধ্যে বিভক্তি থাকলেও বর্তমানে দিদার ও বাকের ভূঁইয়ার অনুসারীরাও মামুনের পক্ষে নেমেছেন ভোটের মাঠে।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য প্রার্থী এস এম আল মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার বাবা দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমিও দুইবার উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলাম। জনগণের জন্য আরও বেশি কাজ করতে চাই বলে নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। ”
জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী হলেও সব প্রার্থীকে সমান গুরুত্ব দিচ্ছেন জানিয়ে মামুন বলেন, “আমি মনে করি বিপুল পরিমাণ ভোট কালেকশন করতে হবে। দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি পরিবারের সদস্য সবাই জনসংযোগ করছে আমার জন্য।
“ভোটররা যাতে সবাই কেন্দ্রে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেন, সেজন্য আমরা বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগের পাশাপাশি উঠান বৈঠকসহ বিভিন্নভাবে আমরা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি।”
আর চট্টগ্রাম-১২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও চাপে আছেন পটিয়া আসনের মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান সংসদ সদস্য হুইপ সামশুল হক চৌধুরী।
টানা তিনবার আওয়ামী লীগের মনোয়ন পেয়ে এ আসনে জয়ী হলেও হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি। তাই তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন।
স্থানীয়দের ভাষ্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বেশির ভাগই সামশুল হকের পক্ষে থাকলেও মনোনয়ন না পাওয়ার পর জনপ্রতিনিধিরা মোতাহেরের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অনেক প্রকাশ্যে না থাকলেও গোপনে সমর্থন দিচ্ছেন সামশুল হককে।
দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে এলাকায় উত্তেজনা রয়েছে, হামলা-সংঘর্ষের মত ঘটনাও ঘটছে।
দলীয় প্রতীক পেয়ে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘দলীয় শপথ ভেঙে’ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন সামশুল হক।
“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার আগে যারা দলের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন, তাদের সবাই হাত তুলে শপথ করেছেন- প্রধানমন্ত্রী যাকে মনোনয়ন দেবে, নেতাদের সবাই মেনে নেবেন। সেখানে তিনিও শপথ করেন। সেই শপথ ভঙ্গ করে নিজে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।”
মোতাহেরুল বলেন, “এর আগে সবাই দলীয় যে মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছিলেন, সেখানে একটি অঙ্গীকার ছিল- একান্ত নিবিড়ভাবে দলীয় প্রার্থীর জন্য কাজ করবেন। সেটাও না মেনে তিনি (সামশুল) নিজেই এখন নির্বাচন করছেন।”
তবে সামশুল হকের দাবি, দলের ‘অনুমতি’ নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।
তিনি বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীদের অনুমতি দিয়েছে। দলের নির্বাচনি কৌশল হিসেবে অনেক সংসদ সদস্যদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
দলের সভানেত্রী অন্যদের মত তাকেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই করা অনুমতি দিয়েছেন বলে হুইপ সামশুলের ভাষ্য।
তিনি বলেন, “কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে এবং উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য এ কৌশল যুগান্তকারী পদক্ষেপ।”
প্রচারের প্রথম দিন থেকেই মোতাহেরুল প্রচারে বাধা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করে সামশুল বলেন, “আমার কর্মী সমর্থকরা যেখানে যাচ্ছে, সেখানে তাদের ওপর হামলা হচ্ছে। বিষোদগার করে বক্তব্য দিচ্ছেন।”
এর বাইরে উপজেলা চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের লড়াইয়ে আছেন, চট্টগ্রাম-৩ (ফটিকছড়ি) আসনে হোসাইন মো. আবু তৈয়ব, চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ উপজেলা এবং সাতকানিয়া উপজেলার কেওচিয়া, কালিয়াইশ, বাজালিয়া, ধর্মপুর ও পুরানগড়) আসনে আব্দুল জব্বার এবং চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে এম এ মোতালেব।
তাদের মধ্যে মোতালেব আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেও আবু তৈয়ব ও আব্দুল জব্বার দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে উপজেলা নির্বাচন করেছিলেন স্বতন্ত্র হিসেবে। সেখানে তারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম-৩ আসনে আট প্রার্থীর মধ্যে আবু তৈয়বের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনি, বর্তমান সংসদ সদস্য তরীকত ফেডারেশনের সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, সুপ্রিম পার্টির শাহাজাদা সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমেদ।
তরমুজ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেয়া আবু তৈয়বের আছে বিভিন্ন এলাকায় কর্মী বাহিনী। নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ও সাইফুদ্দীন আহমেদের আছে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ তরিকার বেশকিছু ভোটার।
আবু তৈয়ব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জনগণ চায় আমি নির্বাচন করি। আমার প্রত্যেকটি এলাকায় নেতাকর্মী আছে, জনগণের ভালোবাসা নিয়ে আমি নির্বাচন করছি।”
আর চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করছেন আবু রেজা মো. নেজাম উদ্দিন নদভী। আগে দুইবার তিনি সংসদ সদস্য ছিলেন।
অতীতে এ আসনটি পরিচিত ছিল জামায়াত ইসলামীর দুর্গ হিসেবে। প্রতিবারেই এ আসন থেকে জয়ী হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করত জামায়াত ইসলামী। ২০১৪ সাল থেকে এ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয় জামায়াত ত্যাগী নদভীকে। পরপর দুইবার এ আসন থেকে নদভী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও আওয়ামী লীগের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি তাকে।
এ আসনে মনোনয়ন পেতে উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে এমপি মনোনয়ন চান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ মোতালেব। তবে কেন্দ্র তাকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তিনি হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
স্থানীয়দের ভাষ্য, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নদভীর বিরোধ আছে। যে সুযোগটি কাজে লাগাতে চান মোতালেব। তার সঙ্গে মোতালেব জামায়াতের নদভী বিরোধী শক্তিও কাজে লাগাতে চান ভোটে।
আবার অনেকেই মনে করেন, এ আসনে বড় ‘ফ্যাক্টর’ লোহাগাড়া উপজেলার ৯ ইউনিয়নের ভোট। মোতালেব সাতকানিয়াকেন্দ্রিক রাজনীতি করায় ওই উপজেলায় তার যোগাযোগ স্বভাবতই কম। টানা দুইবার সংসদ সদস্য এবং জামায়াত সংশ্লিষ্টতার কারণে নদভীর একটি বলয় আছে এ উপজেলা এবং সাতকানিয়া এলাকায়।
এরই মধ্যে দুই জনের ভোটের প্রচারে হামলা-সংঘর্ষের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
সাতকানিয়া এলাকায় মোতালেবের নির্বাচনি সমন্বয়কের দায়িত্বে আছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক ফোরামের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় নেতা ডা. মিনহাজুর রহমান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাতাকানিয়া পৌর আওয়ামী লীগ, লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ এম এ মোতালেবের হয়ে কাজ করছেন।
নির্বাচনি এলাকার অন্তর্গত সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ার ২০টি ইউনিয়নের মধ্যে সাতকানিয়ার আটজন, লোহাগাড়া উপজেলার পাঁচজন চেয়ারম্যান সরাসরি এমএ মোতালেবের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। তাছাড়া সাতকানিয়ার পৌর মেয়র, ভারপ্রাপ্ত উপজেলা চেয়ারম্যানও মোতালেবের পক্ষে আছেন।
এম এ মোতালেবের জয়ের বিষয়ে আশাবাদী মিনহাজুল বলেন, “এলাকার মানুষ সংসদ সদস্য ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর ক্ষুব্ধ; জনগণ সেটি ব্যালেটের মাধ্যমে প্রকাশ করবে।”
চট্টগ্রাম-১৪ আসন থেকে এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন নজরুল ইসলাম চৌধুরী। তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল জব্বার।
সংসদ সদস্য নজরুল মনে করেন, তার ‘ক্লিন ইমেজ’ নির্বাচনের মূলধন। কারো সাথে বিরোধ-সংঘাতে না জড়ানোর কারণে এলাকার মানুষ তাকে তৃতীয়বারের মত নির্বাচিত করবেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নজরুল বলেন, “আমি টানা দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি, যা উন্নয়ন করেছি বিগত ৫০ বছরেও এরকম কোনো উন্নয়ন হয়নি চন্দনাইশে। আমি সংসদ সদস্য হিসেবে আমি কোন অন্যায় বা দুর্নীতি করিনি। এলাকার মানুষ আমাকে ভালোবাসে।”
স্থানীয়দের ভাষ্য, টানা দুইবার সংসদ সদস্য থাকায় নজরুলের একটি বলয় আছে ওই এলাকায়। নির্বাচনে সেটি কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাবেন তিনি। পাশাপাশি এ আসনের ছয়টি ইউনিয়ন সাতকানিয়া উপজেলার, যেগুলোতে চন্দনাইশের উপজেলা চেয়ারম্যান জব্বারের সম্পৃক্ততা কম।
সংসদের ভোট করতে স্থানীয় সরকারের পদ ছাড়লেন ৬১ জন
একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতি করা জব্বার সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী অলি আহম্মেদের হাত ধরে বিএনপি’তে যোগ দেন। পরে অলি আহম্মেদ বিএনপি থেকে বের হয়ে এলডিপি গঠন করলে সে দলে চলে আসেন জব্বার। ছিলেন এলডিপি’র যুগ্ম-সম্পদকের দায়িত্বে। এলডিপি’র মনোনয়ন নিয়ে দুই বার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া জব্বার দল থেকে বহিষ্কার হন ২০১৫ সালে। পরের বছর তিনি দলবল নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
২০১৯ সালে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হউন। পরে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয়ী হোন।
জব্বার বলেন, “আমাকে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দল থেকে মনোয়ন দেওয়া হয়নি। কিন্তু আমি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করেছিলাম। এবার দলীয় সিদ্ধান্তে নির্বাচন করছি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।
“এলাকায় দেখেন হাজার হাজার লোক আমার সাথে আছে। সবাই আমার পক্ষে। আশা করি ভোটে নির্বাচিত হব।”