মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে মন্তব্য করেছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
তিনি বলেছেন, “মাতারবাড়ী হবে দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুর। বাংলাদেশের অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এই গভীর সমুদ্র বন্দর।
“এখানে টার্মিনাল ও রোড একসাথে কাজ হবে। কক্সবাজারে রেল আসছে, সেটা মাতারবাড়ীতে যুক্ত হবে। বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা আমরা অতীতে শুধু গল্পেই শুনেছি, এটা বাংলাদেশে বাস্তবে করে দেখালেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।"
শনিবার কক্সবাজারের মহেশখালীতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রথম টার্মিনালের নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং চ্যানেলের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে উপলক্ষে বৃহস্পতিবার নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রস্তুতি পরিদর্শনে আসেন।
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “মাতারবাড়ীর কথা আমরা কেউ কিন্তু ভাবিনি। এর কথা প্রথম বলেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনিই এ স্বপ্ন দেখেছেন এবং তা বাস্তবায়ন করেছেন।"
এ বন্দরের ফলে প্রতিবেশীরাও সুফল পাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই গভীর সমুদ্রবন্দর শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতিকেই সমৃদ্ধশালী করবে না, আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেটাকে বলেন সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। বন্ধু প্রতিম দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক রেখে তাদের একসাথে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। মাতারবাড়ী এটার একটা সিম্বল।
"“শুধু বাংলাদেশ নয়, আশেপাশের বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো সকলেই এর সুফল পাবে।"
গভীর সমুদ্রবন্দরের অর্থনৈতিক সুফল তুলে ধরে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেন, “স্টাডিতে যেটা এসেছে- এটা জাতীয় অর্থনীতি দুই বিলিয়ন ডলার যোগ করবে। সিঙ্গাপুর, কলম্বো বা অন্য বন্দরে আমরা যে লাইটার করতাম, সেটা ১০-২০% কমবে। এটা বিরাট ভূমিকা রাখবে।
“পাশাপাশি মাতারবাড়ীর কারণে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দর নতুনভাবে চাঙা হবে।"
এ সময় চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, “টার্মিনাল নির্মাণের টেন্ডার চূড়ান্ত অনুমোদন হয়েছে। এক মাসের মধ্যে কাজ শুরু হবে। জাপানি একটি প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত হয়েছে, তারাই কাজ করবে। আর গভীর সমুদ্র বন্দরের সংযোগ সড়ক (মাতারবাড়ী থেকে চকরিয়া চার লেনের) টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন আছে।
“আড়াই থেকে তিন বছরের মধ্যে টার্মিনাল নির্মাণ কাজ ও সড়কের কাজ শেষ হবে।"
প্রথম টার্মিনালে একটি কন্টেইনার জেটি ও একটি মাল্টিপারপাস জেটি হবে জানিয়ে বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, “প্রথম ফেজের কাজ শেষ হলে একসাথে চারটি এবং দ্বিতীয় ফেজের কাজ শেষে ৮টি জাহাজ ভিড়তে পারবে। ড্রাফট (চ্যানেলের গভীরতা) হবে ১৮ মিটার। জোয়ারের সময় যা ২০ মিটার হবে।
“১ মিলিয়ন মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার কার্গো জাহাজ এবং আট থেকে দশ হাজার টিইইউএস (২০ ফুটের দৈর্ঘ্যর একটি কন্টেইনারকে একক ধরে) ধারণক্ষমতার কন্টেইনার জাহাজ মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে ভিড়তে পারবে।"
কক্সবাজারের মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রথম টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শুরু হতে যাচ্ছে শনিবার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে। এখানে সাগর থেকে টার্মিনাল পর্যন্ত প্রায় ১৪ কিলোমিটার লম্বা চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) আগেই তৈরি করা হয়েছে।
মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় এই নৌপথ খনন করে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)। গত ২০ সেপ্টেম্বর চ্যানেলটি বন্দর কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করা হয়। শনিবার সেটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
২০২৬ সালে এই টার্মিনাল চালুর কথা রয়েছে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
মাতারবাড়ী বন্দর চালু হলে সরাসরি ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি সহজ হবে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা কলম্বোর মতো বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানির দরকার হবে না। এতে সময় ও খরচ দুটোই কমবে।
মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেলের শেষ প্রান্তে এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহারের জন্য দুটি জেটি আছে। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে প্রকল্পের সরঞ্জাম বহনকারী জাহাজ ভেড়ানো শুরু হয়।
এ পর্যন্ত ১২০টির বেশি জাহাজে করে এখানে প্রকল্পের সরঞ্জাম ও কয়লা আনা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটির অদূরে ও সাগর উপকূল থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার ভেতরে নির্মাণ হবে গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রথম টার্মিনাল।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের একনেকে অনুমোদন হয় ২০২০ সালের মার্চে। সমুদ্রবন্দর ও সংযোগ সড়কসহ এই প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয় ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা।
প্রকল্প খরচের মধ্যে প্রায় ১২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান। আর সরকার ২ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা ও চট্টগ্রাম বন্দর ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকা যোগান দিচ্ছে।