দেশের কোন সাফারি পার্ক থেকে নয়, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার সিংহ জুটি বাদশাহ-নোভার উত্তরসূরি আসছে আফ্রিকা থেকে।
চিড়িয়াখানার নিজস্ব তহবিল থেকে কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে কেনা পাঁচ প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে এক জোড়া সিংহ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই চিড়িয়াখানায় এসে পৌঁছাবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বছর ছয় আগে ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়া হয় বাদশাহ-নোভার। কিন্তু তাদের ঘরে ছেলেপুলে আসেনি। এছাড়া প্রাণী দুটি তাদের গড় আয়ুর শেষ প্রান্তে থাকায় এই দম্পতির নিজস্ব উত্তরসূরি আসার সম্ভাবনাও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে।
তাই গত বছর বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে সিংহ চেয়ে চিঠি দিয়েছিল চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এক বছর পরও সে চিঠির সাড়া মেলেনি। তাই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সিংহ কেনার উদ্যোগ নেয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটরের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক শাহাদাত হোসেন শুভ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠির কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এর মধ্যেই চিড়িয়াখানার সিংহ জোড়া খাওয়া দাওয়াও কমিয়ে দিয়েছে, শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। যে কোনো সময় মৃত্যু হতে পারে সিংহগুলোর। তাই নিজস্ব তহবিল থেকে সিংহ কেনার পরিকল্পনা করেছি আমরা।"
এক কোটি ৬৯ লাখ টাকা ব্যয়ে যে পাঁচ ধরনের প্রাণী কেনা হচ্ছে তার মধ্যে সিংহ রয়েছে বলে জানান ডেপুটি কিউরেটর।
বন্দরনগরীর এই চিড়িয়াখানাটিতে বর্তমানে প্রায় ৭০ প্রজাতির ছয় শতাধিক পশু-পাখির মধ্যে এই সিংহ জুটির বয়স ১৭ বছরেও বেশি।
প্রায় ১১ বছর নিঃসঙ্গ কাটানো নোভার জন্য সঙ্গী আনার উদ্যোগ নিয়েছিল চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। ২০১৬ সালে অদল-বদল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার সিংহী ‘বর্ষাকে’ রংপুরে পাঠিয়ে সেখান থেকে আনা হয় সিংহ ‘বাদশাহকে’।
বাদশাহকে চট্টগ্রামে এনে কিছুদিন আলাদা খাঁচায় রাখা হয়। এর পর ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সিংহ এবং সিংহীকে এক খাঁচায় দেওয়ার সময় বেশ ধুমধামের আয়োজন করে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। সিংহ-সিংহীর ‘বিয়ে’ বলে প্রচার করা হয় ওই আয়োজনকে, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়।
কিন্তু বিগত বছরগুলোয় চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় বাঘসহ বিভিন্ন প্রাণী একাধিকবার বাচ্চা প্রসব করলেও সিংহ-সিংহীর বেলায় তা হয়নি।
সিংহরা সাধারণত ১৫ থেকে ১৭ বছর বাঁচে।
শুভ বলেন, “সিংহ-সিংহী আড়াই বছর বয়সেই প্রজননক্ষম হয় এবং তিন বছরের মধ্যে প্রথম বাচ্চা প্রসব করে। ১২ বছর পর এ প্রাণীগুলোর প্রজনন ক্ষমতা আর থাকে না। এর মধ্যে সেগুলো সর্বোচ্চ পাঁচবার শাবকের জন্ম দেয়।”
তিনি জানান, যে সময়ে বাদশাহকে চট্টগ্রামে আনা হয়েছিল, তখন বয়স ছিল প্রায় ১৩ বছর। আর সিংহী নোভার বয়স ছিল ১১ বছর।
“মানে সিংহ-সিংহী প্রজনন সময়ের শেষ দিকে এসে এক হয়েছিল। তাছাড়া চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার সিংহীর শারীরিক গঠন ভালো থাকলেও রংপুর থেকে আসা বাদশাহর অবস্থা ছিল নাজুক। প্রায় এক বছর লেগেছে বাদশাহকে শারীরিকভাবে সুস্থ করতে।”
আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ায় যে কোন সময়ে মৃত্যু হতে পারে চিড়িয়াখানার সিংহ দুইটির। তাই কর্তৃপক্ষ চাইছে আগে শূন্যতা পূরণ করতে বলেও জানান এই পশু চিকিৎসক।
এর মধ্যে প্রথম দফায় চিড়িয়াখানার প্রাণী পরিবারে যুক্ত হয়েছে ক্যাঙ্গারু ও লামা। হল্যান্ড থেকে আনা তিন জোড়া করে ক্যাঙ্গারু ও লামা চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় পৌঁছায় শুক্রবার সকালে।
বাকি এক জোড়া সিংহ, চার জোড়া ওয়াইল্ড বিস্ট ও তিন জোড়া লাল-সবুজ ম্যাকাও পাখি অল্প সময়ের মধ্যে এসে পৌঁছাবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ। যেগুলো মূলত দক্ষিণ অফ্রিকা থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এর আগেও প্রাণী সংগ্রহ করেছে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে চিড়িয়াখানার নিজস্ব তহবিলের ৩৩ লাখ টাকায় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে চট্টগ্রামে আনা হয় এ জোড়া বাঘ- বাঘিনী। যাদের নাম দেয়া হয় ‘রাজ’ ও ‘পরী’।
এই রাজ-পরীর ঘরে জন্ম নেয় পাঁচটি সাদা বাঘ, দেশের প্রথম সাদা বাঘের জন্ম চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় বলে কর্তৃপক্ষের দাবি। এক জোড়া বাঘ থেকে ছয় বছরের মধ্যে চট্টগ্রামে বাঘের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৬টি। আরও কয়েকটি বাঘের ছানা বিভিন্ন সময়ে জন্মের পরপরই মারা যায়। তবে গত ১৭ বছরে কোনো সিংহের প্রজনন হয়নি এ চিড়িয়াখানায়।
এর আগে ২০০৫ সালের ১৬ জুন চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় জন্ম নেওয়া দুটি সিংহীর নাম রাখা হয় ‘বর্ষা’ আর ‘নোভা’। তাদের জন্মের কিছুদিন পর তাদের মা ‘লক্ষ্মী’ এবং ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাবা ‘রাজ’ মারা যায়।
১৯৮৯ সালে বন্দরনগরীর ফয়’স লেক এলাকায় ছয় একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত এ চিড়িয়াখানায় বর্তমানে বাঘ, সিংহ, হরিণ, কুমির, ভাল্লুকসহ প্রায় ৭০ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে।
কর্মকর্তাদের দাবি, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা দেশের লাভজনক চিড়িয়াখানার একটি। সরকারি কোনো অনুদান ছাড়া টিকেটি বিক্রির টাকা দিয়ে এটি পরিচালিত হয়। চিড়িয়াখানায় আয় হওয়া অর্থ দিয়েই নতুন প্রাণী সংগ্রহ করা হচ্ছে।
প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার দর্শনার্থী এ চিড়িয়াখানা দেখতে আসেন। এর মধ্যে সাপ্তাহিক ছুটি কিংবা অন্যান্য ছুটির দিনে তা সাত থেকে ১০ হাজারে পৌঁছায়।
টিকেট বিক্রির টাকা থেকেই চিড়িয়াখানার ২০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী বেতন পরিশোধ, পশু খাদ্য ও উন্নয়ন খরচ বহন করা হয়।