নদীর পলি প্রবাহে প্রচুর পুষ্টি উপকরণ, মৌসুমি বায়ুর প্রভাব, অনুকূল তাপমাত্রা ও সূর্যালোকের কারণে বাদামি শৈবালের স্ফুরণ ঘটে থাকে।
Published : 20 Jan 2025, 01:37 AM
কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ সৈকতজুড়ে চলছে ফাইটোপ্লাঙ্কটন ব্লুম বা শৈবাল স্ফুরণ, যা বিশ্বের অন্য সৈকতের চেয়ে ভিন্ন।
প্রাকৃতিক কারণে এ ধরনের শৈবাল স্ফুরণ স্বল্পস্থায়ী, যার স্তর পড়ে যায় পানির ওপর, তা সাগরের বাস্তুতন্ত্র ও মৎস্যসম্পদের জন্য কতটা উপকারী, আর ক্ষতিই বা কতটুকু, এসব জানতে দেশেই শুরু হয়েছে গবষেণা।
ফাইটোপ্লাঙ্কটন হল অতিক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ বা শৈবাল। হঠাৎ করে এর সংখ্যা খুব বেশি বেড়ে গেলে তাকে বলে ব্লুম বা স্ফুরণ। এতে বদলে যায় পানির রঙ। এর আরেক নাম ‘অ্যালগল ব্লুম’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন সৈকতে শৈবালের যে লালচে স্ফুরণ দেখা যায়, তা ক্ষতিকর অ্যালগল ব্লুম (এইচএবি) নামে পরিচিত। আর বঙ্গোপসাগরে যে বাদামি শৈবালের স্ফুরণ ঘটে, তা মূলত ডায়াটম গোত্রের শৈবালের কারণে হয়ে থাকে।
তারা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে এসে পড়া নদীগুলোর পানি প্রবাহে ডায়াটম বাড়ার প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপকরণ বেশি থাকে। এছাড়া উপযুক্ত লবণাক্ততা, সূর্যের আলো ও অনুকূল তাপমাত্রায় সাগরে এই স্ফুরণ ঘটে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কক্সবাজার সৈকতে শৈবাল স্ফুরণ ক্ষতিকারক বা উপকারি কি না তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে পর্যবেক্ষণে উপকারের আভাসই মিলছে।
প্রকৃতিতে এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব কতটা এবং প্রবণতা ও পরিমাণ কেমন তা জানতে গবষেণার প্রয়োজন বলে তারা মনে করছেন।
ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বঙ্গোপসাগর তীরের তামিলনাড়ু রাজ্যের কলপাকুম সৈকতেও এই ধরনের শৈবাল স্ফুরণ দেখা যাওয়ার কথা তুলে ধরে দেশের একজন গবেষক বলছেন, এই ডায়াটম শৈবাল সংগ্রহ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায় কি না তা জানতে হলেও গবেষণা দরকার।
শৈবাল স্ফুরণের কারণ কী
অতিক্ষুদ্র জলজ শৈবাল সূর্যের আলোতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপকরণ পেলে অল্প সময়ের মধ্যে হঠাৎ সংখ্যায় বহু গুণে বেড়ে যায়, আর এ দশাকে বলা হয় স্ফুরণ।
প্রয়োজনীয় সেসব পুষ্টি উপকরণ হল- নাইট্রেট, ফসফেট ও সিলিকেট। বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার সৈকতের আশপাশের এলাকা নানা কারণে এসব পুষ্টি উপকরণে ভরপুর।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়রে সাবেক সচিব ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলনে, “যেসব নদী বঙ্গোপসাগরে মিশেছে, সেগুলো অন্য দেশের নদীর তুলনায় বেশি পলি বহন করে আনে। বর্ষায় প্রচুর বৃষ্টির পানিও এসব নদীবাহিত হয়ে সাগরে আসে। এতে প্রচুর নাইট্রেট, ফসফেট ও সিলিকা থাকে, যা পুষ্টি উপকরণ হিসেবে ডায়াটমের বংশ বিস্তারের জন্য খুব উপযোগী।
“পাশাপাশি আমাদের কৃষিতে যে টিএসপি ও ইউরয়িা সার ব্যবহার হয় সেগুলো এবং গৃহস্থালী র্বজ্য ও শিল্পের র্বজ্য নদী হয়ে সাগরে এসে পড়ে। এগুলোও নাইট্রেট এবং ফসফেটের আরেকটি বড় উৎস।”
বাংলাদশে ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিওআরআই) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম কক্সবাজার সৈকতে শৈবাল স্ফুরণের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছেন ২০২১ সাল থেকে।
তিনি শৈবাল স্ফুরণের হার ও এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে গত ডিসেম্বর মাস থেকে বিওআরআই এর অধীনে ‘অ্যাসেসমেন্ট অব ইউট্রপিকেশন অ্যাট দি ইস্টার্ন কোস্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা শুরু করেছেন।
বিভিন্ন সময় সেন্ট মার্টিন, টেকনাফ, শামলাপুর, পাটুয়ারটেক, নাফ নদীর মোহনা, সোনার পাড়া, হিমছড়ি, নুনিয়ার ছড়া ও সোনাদিয়া এলাকার সৈকতে এই শৈবাল স্ফুরণ দেখেছেন তরিকুল ইসলাম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নদীর পানির মাধ্যমে আসা পুষ্টি উপকরণগুলো সাগরের জলস্তরের গভীরে জমা হয়। বর্ষায় দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রবাহের (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) কারণে পুষ্টি উপকরণ সমৃদ্ধ গভীর স্তরের পানি উপরের স্তরে উঠে আসে।
এছাড়া বঙ্গোপসাগরে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের কারণেও সমুদ্রের নিচের স্তরের পুষ্টি সমৃদ্ধ পানি উপরের স্তরে উঠে আসে। ফলে বর্ষার পরে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করলে পূর্ণিমার জোয়ারের সময় বঙ্গোপসাগরে নিয়মিত শৈবাল স্ফুরণ হয়।
এছাড়া উত্তর-র্পূব মৌসুমি বায়ু প্রবাহের সময় (অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি) একই কারণে এই স্ফুরণ দেখা যায়। তবে এসময় ঠাণ্ডা বাতাসের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কম থাকে বলে পরিমাণে বর্ষার চেয়ে স্ফুরণ কম ঘটে।
সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন সৈকতে, যেমন আরব সাগরের তীরে যে ‘রেড টাইড’ বা লাল জোয়ার দেখা যায় তা মূলত হয় ডায়নোফ্ল্যাজেলেট প্রজাতির শৈবালের স্ফুরণের কারণে। এটা বিষাক্ত ধরনের, যা সামুদ্রিক জীব ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর।
তিনি বলেন, কক্সবাজার সৈকতে যে শৈবাল স্ফুরণ হয় তার নমুনা সংগ্রহ করে বিওআরআইতে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর ৯৯ শতাংশই ডায়াটম গোত্রের শৈবাল, যা মূলত সিলিকাপুষ্ট এবং বিষাক্ত নয়। এর রঙ বাদামী বা গাঢ় বাদামি।
উপকারী না অপকারী
শৈবালের স্ফুরণ সাধারণত কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে এবং প্রাকৃতকি উপায়ে ফাইটোপ্লাঙ্কটন বা শৈবাল পচে গেলে স্ফুরণের সমাপ্তি ঘটে।
শৈবালের স্ফুরণ সাগরের খাদ্যশৃঙ্খলের জন্য উপকারী। তবে কিছু স্ফুরণ ক্ষতিকারকও হয়।
তাহলে কক্সবাজার সৈকতে যে শৈবালের স্ফুরণ হচ্ছে তা কি ভালো, না ক্ষতিকর, এই প্রশ্নে তরিকুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন সময় কক্সবাজার সৈকতের বিভিন্ন স্থানে স্ফুরণের সময় নমুনা সংগ্রহ করেছেন তিনি। সে সময় প্রচুর চিংড়ি পোনা পেয়েছেন। চিংড়ি ও ছোট মাছ অতিক্ষুদ্র এই শৈবাল খেয়ে থাকে।
“এছাড়া এই শৈবাল সাগরের অতিক্ষুদ্র জীব জুপ্ল্যাঙ্কটনের খাদ্য, যা পরে বড় মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণীর খাবারে পরিণত হয়। তাই শৈবালের স্ফুরণ সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কিন্তু শৈবালের স্ফুরণের নেতিবাচক প্রভাবও আছে।”
সমুদ্র উষ্ণায়নের সঙ্গে যেভাবে বাড়ছে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন বন
বিওআরআই’র এই জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, “বঙ্গোসাগরে সিংহভাগই ডায়াটম গোত্রের অতিক্ষুদ্র শৈবাল। কিন্তু অন্য প্রজাতির কিছু শৈবালও আছে। তাছাড়া র্দীঘ সময় ধরে যদি স্ফুরণ চলতে থাকে তাহলে পানিতে অক্সিজেন কমে কার্বন ডাই অক্সাইড বাড়ে। এমনকি অ্যামোনিয়াও উৎপন্ন হতে পারে। অক্সিজেন কমে গেলে সামুদ্রিক প্রাণি বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যায়।
“আর বিষাক্ত এই শৈবাল মাছ এবং পরে মাছ থেকে মানুষের শরীরে চলে আসতে পারে, যা র্দীঘমেয়াদে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে।”
এছাড়া অতিরিক্ত স্ফুরণ হলে পানির স্বচ্ছতা কমে যায়। এতে সূর্যের আলো পানিতে প্রবেশে বাধা পায়, যে কারণে সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রবালের বৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হয়। এটা হলে সাগরের পুরো বাস্তুতন্ত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে জানান তরিকুল ইসলাম।
তার পর্যবেক্ষণ হল- গত চার বছরে সৈকতের বিভিন্ন অংশে হওয়া শৈবালের স্ফুরণ খুব বেশি সময় স্থায়ী হয় না। কয়েক ঘণ্টা বা দুই এক দিনের মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়।
প্রয়োজন গবেষণা
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে শৈবালের স্ফুরণ একটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও এর প্রতিক্রিয়া জানা জরুরি। কারণ নেতিবাচক প্রভাব থাকলে তাতে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র ও সম্পদের ক্ষতি হতে পারে, যা স্থানীয় র্অথনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সে জন্য গবেষণা জরুরি।
সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, “বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো প্রভাবে এমন স্ফুরণ হচ্ছে কি না তা জানতেও গবেষণা প্রয়োজন।
“গবেষণা হলে জানা যাবে, এখানে কতটা ঘন ঘন এবং কী মাত্রায় শৈবালের স্ফুরণ ঘটছে। যদি অতিরিক্ত হয়ে থাকে, তাহলে তা নিয়ন্ত্রণে মনুষ্যসৃষ্ট পুষ্টি উৎস নিয়ে কাজ করতে হবে। যেমন কৃষি, শিল্প ও গৃহস্থালী র্বজ্য খাল-নদীতে পড়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।”
এছাড়া স্ফুরণের কারণে যে অতিরিক্ত শৈবালের জন্ম হয় সেগুলো আহরণ কোনো খাদ্য উপকরণ বা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা যায় কি না সেই বিষয়টিও খতিয়ে প্রয়োজন বলে মনে করেন এই সমুদ্রবিজ্ঞানী।
তিনি বলেন, “বিভিন্ন সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদ রূপান্তর করে বাণিজ্যিক ব্যবহারের নজির আছে। এই সম্ভাবনাও যাচাই করা উচিত।”
বিওআরআই’র জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক র্কমর্কতা তরিকুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বঙ্গোপসাগরের শৈবাল স্ফুরণের প্রকৃতি বিষয়ে বিস্তারিত জানতেই গবেষণা শুরু করেছেন তিনি।
এই গবষেণার পর বঙ্গোপসাগরে শৈবাল স্ফুরণ কত ঘন ঘন হয়, এর স্থায়ীত্ব কেমন এবং এতে উপকারী ও অপকারী শৈবালের উপস্থতির পরিমাণ কেমন সে বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যাবে।