বিস্ফোরণের পর কানে কম শুনতে পাচ্ছেন স্থানীয়দের কেউ কেউ।
Published : 05 Mar 2023, 10:26 PM
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের সামনেই কবির হোসেনের চায়ের দোকান। বরিশাল থেকে এসে দুই দশক ধরে ওই এলাকায় দোকান চালাচ্ছেন তিনি। শনিবারের বিস্ফোরণে সেই দোকান ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে এই বিস্ফোরণের পর কবির মনে করলেন নয় মাস আগে বিএম কন্টেইনার ডিপোর বিস্ফোরণের কথা।
শক্তিশালী সেই বিস্ফোরণেও কবিরের দোকানের কাচ ভেঙে পড়েছিল। তবে এবারের ক্ষতিকে অপূরণীয় বলছেন তিনি।
টিনশেডের এই দোকানেই কয়েক বছর কারিগরের কাজ করছেন শহীদ। এই বিস্ফোরণের পর এখন শহীদ মনে করছেন, তিনি নতুন জীবন পেয়েছেন। তবে ঘটনার প্রায় ১৬ ঘণ্টা পরও কানে কম শুনতে পাওয়ার কথা জানালেন তিনি।
শহীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিকালে মসজিদে আসরের আজান হচ্ছিল। আমি দোকানের পেছনে পারাটা বানাচ্ছিলাম। ক্যাশে বসে ছিলেন মালিকের ছেলে নাঈম পারভেজ। আর দুই ব্যক্তি বসে চা খাচ্ছিলেন।
“এমন সময় হঠাৎ বিকট শব্দের পর একটি বাতাস আসে; সবকিছু ধোঁয়া হয়ে যায়। কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আমি মাটিতে বসে যাই এবং গায়ে থাকা কাপড়চোপড় সব ছিঁড়ে যায়। কারখানার ভেতরে আগুন .… কিছুক্ষণ কানে কিছু শুনতে পাইনি।”
শহীদ জানান, বিস্ফোরণের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দোকানের সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। টিনের চাল ভেঙে বাঁকা হয়ে যায়। ফ্যান খুলে পড়ে যায় এবং দোকানে থাকা ফ্রিজ, টেলিভিশনও ভেঙেচুরে যায়।
দোকানের মালিক কবির বলেন, বেলা ৩টা পর্যন্ত দোকানে থেকে বাসায় যান তিনি। তখন তার ছেলে নাঈম দোকানে বসেন। বিস্ফোরণের পরপর সে মাটিতে পড়ে যায়, হাত-পা কেটে রক্ত বের হয়।
রোববার সকাল পর্যন্ত নাঈম কানে শুনতে পারছিলেন না, বলেন তিনি।
গত বছরের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর বিস্ফোরণ হলে ফায়ার সার্ভিসকর্মীসহ ৫১ জন নিহত হন। সেই বিস্ফোরণের আঁচ অনেক দূর থেকে পেয়েছিল স্থানীয়রা।
বিএম ডিপো থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের দোকানে কাচ ভাঙার ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে কবির বলেন, বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের পর তার দোকানের শোকেইসের কাচগুলো ভেঙে চুর হয়ে গিয়েছিল। তবে এবারের ক্ষতি ‘অপূরণীয়’।
শিল্পে ব্যবহৃত অক্সিজেন প্রস্তুতকারী সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের কারখানাটিতে শনিবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বিস্ফোরণের পর আগুন লেগে যায়। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেই আগুন নিয়ন্ত্রণ নেয়।
এ ঘটনায় ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ২৪ জন। তাদের মধ্যে ১৯ জন এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ঘনবসতির মধ্যেই সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট; উবে গেল প্রাণ, রেখে গেল ধ্বংসচিহ্ন
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের বিভীষিকা আহতদের বয়ানে
‘ত্রুটির জন্য’ একবার নোটিস পেয়েছিল সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট
কারখানার সুপারভাইজার সানাউল্লাহ জানান, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ডিউটি তার। কারখানা থেকে কয়েকশ গজ দূরে তারা ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন।
তিনি বলেন, “প্রতিদিন ৪টার পর বাসায় গিয়ে নামাজ পড়ে আবার কারখানায় আসি। গতকাল (শনিবার) ৪টার পর বের হয়ে বাসায় যাচ্ছিলাম। বাসার কাছে যেতেই বিকট শব্দ শুনতে পেয়ে আবার পেছনে ফিরে আসি।
“তখনও বুঝতে পারিনি যে আমাদের কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটেছে। ফিরে আসার পর আশেপাশে ধোঁয়ায় কিছু দেখতে পারছিলাম না। কারখানার কাছে এসে দেখি রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের লোহার পাত, টিন পড়ে আছে। ঘুরে অফিসে এসে ঢুকলাম। তখন দেখলাম একজন আহত অবস্থায় পড়ে আছে।”
সানাউল্লাহ বলেন, “যদি আর ৫/১০ মিনিট পর কারখানা থেকে বের হতাম তাহলে হয়ত আমিও হতাহত হতাম।”
বিস্ফোরণে কারখানার বিভিন্ন সরঞ্জাম উড়ে কয়েকশ গজ দূরে গিয়েও পড়ে। আর তার আঘাতে নিহত হন দুজন।
দুর্ঘটনাকবলিত প্ল্যান্টটিতে উৎপাদন করা হত অক্সি-এসিটিলিন গ্যাস। এটি মূলত শিল্পে ব্যবহার করা অক্সিজেনের প্ল্যান্ট। অক্সি-এসিটিলিন গ্যাসের শিখা দিয়ে লোহার পাত কাটা হয়। একই সঙ্গে রি রোলিং মিলে লোহা গলাতে ব্যবহার করা হয়।
আশপাশের জাহাজভাঙা শিল্প ও স্টিল রি-রোলিং মিলে ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করা হয় সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট থেকে।
কারখানার সুপারভাইজার সানাউল্লাহ বলেন, এখন জাহাজ কাটার কাজ কম থাকায় অক্সিজেন উৎপাদনও কম হচ্ছে। তাই কাজে শ্রমিকও কম ছিল। শুক্রবার কারখানা বন্ধ ছিল। শনিবার সকালে চালু হয়েছে। শিফটিং ডিউটিতে দুর্ঘটনার সময় ছয়জন ডিউটিতে ছিল। তাদের মধ্যে তিনজন নামাজের জন্য বের হয়ে যান। তাদের সবাই হতাহত হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের সড়কেই আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে। যেগুলোর মধ্যে আছে এইচ স্টিল, অক্সি অক্সিজেন কোম্পানি, সুপার স্টিল, আল সাফা স্টিল, ব্রাদার্স স্টিল, ব্রাদার্স অক্সিজেন ও রুবাইয়া ভেজিটেবল ওয়েল মিল।
এর মধ্যে আল সাফা ছাড়া সবগুলো কারখানা দীর্ঘদিন বন্ধ। এগুলোর মধ্যে রুবাইয়া ভেজিটেবল ওয়েল মিল ও এইচ স্টিল মিল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সব কারখানা চালু থাকলে হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি হত বলে মনে করেন স্থানীয়রা।