নিহতদের দুজন শিক্ষার্থী, অন্যজন পথচারী বলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (জনসংযোগ) কাজী মো. তারেক আজিজ তথ্য দিয়েছেন।
Published : 17 Jul 2024, 01:38 AM
চট্টগ্রাম নগরীতে একই স্থানে কর্মসূচি ঘিরে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার দলীয় কয়েকটি সংগঠনের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে তিনজন নিহত এবং অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছেন, যা নিয়ে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ চলছে।
সংঘর্ষে আগেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন। একই দাবি সংষর্ষে জড়ানো উভয় পক্ষের নেতৃত্ব দানকারীদের।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের দাবি, তাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে হামলা করেছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। এ সময় তারা গুলিও চালায়।
বিপরীতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দাবি, কোটা বিরোধিতাকারীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে। মুরাদপুরে একটি ভবনের ছাদে ছাত্রলীগ কর্মীদের আটকে রেখে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করেছে।
সংঘর্ষের সূত্রপাত যেভাবে
প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোটাবিরোধীরা মঙ্গলবার দুপুরে ষোলশহর রেল স্টেশনে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেন। সেখানে দুই নম্বর গেট এলাকায় আগেই অবস্থান নিয়েছিলেন সরকারদলীয় বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
আন্দোলনকারীরা ষোলশহর রেল স্টেশন এলাকায় অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করে। তখন চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের দিক থেকে এগোতে থাকে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। সে সময় দুই পক্ষ পরস্পরকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়তে থাকে।
তখন মুরাদপুর থেকে জিইসি পর্যন্ত সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সড়কে বিস্ফোরণের শব্দও শোনা যায়। এ সময় অস্ত্র হাতে কয়েকজনকে দেখা গেছে। তবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি।
পুলিশ দুই পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে।
সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া সাংবাদিকরাও দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গিয়ে কয়েকজন মারধরের শিকার হয়।
ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মী মিছিল নিয়ে দুই নম্বর গেটের দিকে এগিয়ে যায়। আর মুরাদপুর অংশে তাদের কিছু নেতাকর্মী আটকা পড়ে।
দুই নম্বর গেট এলাকায় লাঠিসোটা নিয়ে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের দলে কিছু নারীকেও দেখা যায়।
মুরাদপুর অংশে আটকে পড়া ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ধাওয়া দিয়ে বেলাল মসজিদের পাশের একটি পাঁচতলা ভবনে আটকে ফেলে কোটাবিরোধীরা।
সংঘর্ষের মাঝে পড়ে কিছু পথচারীও সেখানে আটকা পড়ে। তারা সবাই ওই ভবনের ছাদে আশ্রয় নেয়। তখন কোটাবিরোধীরা লাঠি ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে ওই ভবন ঘিরে ফেলে।
ভবনে আটকে থাকা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে দুজনকে পাঁচতলার ছাদ থেকে ছুড়ে নিচে ফেলা হয় বলে অভিযোগ করেছে ছাত্রলীগ। ভবনটিতে আটকে পড়াদের মেরে রক্তাক্ত করে ছাদে ফেলে রাখার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
ওই ভবনে আহতদের মধ্যে ১০ জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছে।
‘পুলিশের সামনেই গুলি ছোড়া হয়’
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি ছিল ষোলশহর রেল স্টেশন এলাকায়। সেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) এর অধিভুক্ত নগরীর বিভিন্ন কলেজ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন কলেজ এবং নগরীর বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়।
অন্যদিকে ওই কর্মসূচি ঠেকানোর ঘোষণা দিয়ে ষোলশহর স্টেশন এলাকায় অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করে নগরীর চট্টগ্র্রাম কলেজ, মহসীন কলেজ, ওমরগণি এমইএস কলেজ, সিটি কলেজ ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা।
দুই নম্বর গেট এলাকায় অবস্থান নেয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আরশেদুল আলম বাচ্চু, নগর যুবলীগ নেতা আবু মো. মহিউদ্দিন, নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান আজিজ, সাবেক ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি এবং নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরসহ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা।
ষোলশহর রেল স্টেশন এলাকায় সাবেক যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের অনুসারীরা, প্রবর্তক মোড় এলাকায় কাউন্সিলর নূর মোস্তফা টিনুর নেতৃত্বে তার অনুসারীরা এবং মুরাদপুর এলাকার রনির অনুসারীরা ছিলেন।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর বিভাগীয় সমন্বয়ক মো. সৈয়দ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অমাদের ওপর কার নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ নেয়। ছাত্রলীগ আগে থেকে হামলার পরিকল্পনা নিয়ে বসেছিল।
“ছাত্রলীগ পুলিশের ছত্রছায়ায় আমাদের সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা করে ও গুলি চালায়। প্রশাসন ছাত্রলীগকে প্রটেকশন দিচ্ছে। পুলিশের সামনে দা, ছুরি, পিস্তল নিয়ে তারা হামলা করেছে। সরকারের কাছে দাবি, আমাদের যৌক্তিক দাবি যেন মেনে নেয়।”
সংঘর্ষে নিহত তিনজনই কোটাবিরোধী আন্দোলনের কর্মী বলে দাবি করেন মো. সৈয়দ হোসেন।
নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে তারা গত কয়েকদিন ধরে ষোলশহর, মুরাদপুর, জিইসি এলাকায় অরাকজ পরিস্থিতি তৈরি করে। আজ তারা কয়েক হাজার কর্মী নিয়ে ছাপাতি, ছুরি ও পিস্তল দিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করেছে। তাদের সাথে সাধারণ ছাত্র নাম নিয়ে বহিরাগতরা হামলায় অংশ নেয়।
“আমরা কোটা সংস্কার নিয়ে নয়, যারা রাজাকার রাজাকার স্লোগান দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এই আন্দোলন এখন আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নয়। এটা ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের আন্দোলন হয়ে গেছে।”
সংঘর্ষের বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী পুলিশ কমিশনার (পাঁচলাইশ) আরিফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ তাদের উভয়পক্ষকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেছে।
“দুপক্ষের হামলায় ছয়-সাতজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সংঘর্ষের সময় পুলিশ কোনো গুলি করেনি।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজকের কর্মসূচিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই কম। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ব্যনারে প্রচুর বহিরাগত অংশ নিয়েছে আজ।”
ভবনে আটকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলা
নগরীর মুরাদপুরে বেলাল মসজিদের পাশে একটি পাঁচতলা ভবনে ধাওয়া খেয়ে আটকে পড়া ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করে গুরুতর জখম করে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, ওই ভবনের ছাদে আটকে পড়া ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বেধড়ক মারধর করা হচ্ছে। অন্য একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রক্তাক্ত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা ছাদে পড়ে আছেন।
নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কর্মীদের ওই ভবনে আটকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে মাথায় ও হাতে-পায়ে। দুজনকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে। একজনের হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছে।
“কোটাবিরোধিতার নামে ইসলামী ছাত্র শিবির ও ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা এই হামলা করেছে। কয়েক ঘণ্টা আহতরা ওই ভবনে আটকে ছিল। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে তাদের উদ্ধার করে আনে। আমাদের ৩৪ জন আহত হয়েছে।”
নগরীর ষোলশহর এলাকায় বন গবেষণা ইন্সটিউটের বিপরীতে নুরুল আজিম রনির ভাড়া বাসার ভবনে গিয়ে হামলা চালানো হয়। সেখানে বাড়ির মালিকের বাসায়ও ভাঙচুর করা হয়।
রনির অভিযোগ কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা কয়েক দফায় ওই বাড়িতে হামলা চালায়।
হাজী মোহাম্মদ মহসীন কলেজ ছাত্রলীগের নেতা মায়মুন উদ্দিন মামুন বলেন, “আমাদের কলেজের জালাল উদ্দিন জুনায়েদ নামের এক ছাত্রের হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছে মুরাদপুরের ওই ভবনে আটকে। আঘাতে তার একটি চোখের গুরুতর জখম হয়েছে।
“সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে জামাত-বিএনপির লোকজন হামলা করেছে। শাহাদাত বিন একরাম নামের আমাদের একজন শিক্ষার্থী এখনও নিখোঁজ।”
চমেক হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, গুরুতর কয়েকজনের অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি চলছে।
সেখানে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের নেতা মাহমুদুল করিম বলেন, “ভবনের ছাদ থেকে দুজনকে ফেলে দিয়েছে। তাদের আঘাত গুরুতর।”
চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সহসভাপতি জাহিদ হাসান সায়মন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ধারালো অস্ত্রের আঘাত করা হয়েছে ছাত্রদের মাথায়। কয়েকজনের হাতের তালু কেটে ফেলেছে। জাবেদ ইকবাল, পারভেজ, জাহেদ অভি, অয়ন, সাগরসহ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছে।”
চমেক হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. তসলিম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের এখানে যারা এসেছেন তাদের মধ্যে তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়ে এসেছেন কমপক্ষে ৩০ জন।
“তাদের মধ্যে গুরুতর আহত দুইজন। নিউরো সার্জারি বিভাগে ১০ জন ভর্তি আছেন। বাকিদের অন্য বিভিন্ন বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আমরা সবার চিকিৎসার জন্য সব ব্যবস্থা করছি।”
নিহত যারা
নিহতরা হলেন চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী ওয়াসিম আকরাম (২৪), ওমরগণি এমইএস কলেজের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমদ শান্ত (২০) এবং অপরজন ফার্নিচার দোকানের শ্রমিক মো. ফারুক।
সংঘর্ষে নিহত শিক্ষার্থী ওয়াসিম আকরাম চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। আরেক নিহত শিক্ষার্থী শান্তর রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া না গেলেও কোটা আন্দোলনকারীরা তাকে নিজেদের কর্মী দাবি করেছে।
নিহতদের দুজন শিক্ষার্থী, অন্যজন পথচারী বলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (জনসংযোগ) কাজী মো. তারেক আজিজ তথ্য দিয়েছেন।
সংযত আচরণ করার অনুরোধ
সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও অনেকে আহত হওয়ার পর সবাইকে সংযত আচরণ করার অনুরোধ করেছেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতারা।
নগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলার নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে মঙ্গলবারের ঘটনায় দুঃখ ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আদালতে বিচারাধীন বিষয়কে রাজপথে ঠেলে এনে রাজনৈতিক হীন স্বার্থ চরিতার্থের অপচেষ্টা সম্পর্কে সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকার এবং ধৈর্য্য ধারণের আহ্বান জানাচ্ছি।
বিবৃতিদাতারা হলেন- নগরের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, উত্তরের সভাপতি এম এ সালাম ও দক্ষিণ জেলার মোতাহেরুল ইসলাম, নগরের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন, দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান ও উত্তরের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান।