চট্টগ্রাম কারাগারে থাকতে চান না বাবুল আক্তার, কাঁদলেন আদালতে

চট্টগ্রাম কারাগারে আসামিদের সঙ্গে থাকা ‘অনিরাপদ’ বোধ করছেন সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2023, 03:12 PM
Updated : 13 March 2023, 03:12 PM

স্ত্রী খুনের মামলার বিচার শুরু হতে যাওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে চট্টগ্রাম কারাগারে বাবুল আক্তারকে রাখার আদেশ দিয়েছে আদালত; যদিও সেখানে থাকতে না চেয়ে আদালতে চোখের জলে ভেসেছিলেন সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা।

কাঠগড়ায় থাকা বাবুল বলছিলেন, চট্টগ্রামের কারাগারকে তিনি তার জন্য অনিরাপদ বোধ করছেন। স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে হত্যার অভিযোগ বিভ্রান্তিমূলক বলেও দাবি করেন তিনি।

সোমবার চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে মিতু হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন হয়। বিচারক বাবুলসহ সাত আসামির বিচার শুরুর জন্য আগামী ৯ এপ্রিল বিচার শুরুর দিন ঠিক করে দেন।

বেলা ১২টার দিকে বাবুলকে আদালতে হাজির করা হয়। শুরুতে ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে কর্মরত অবস্থায় অস্ত্রসহ তিন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের একটি মামলায় তার সাক্ষ্য নেয় আদালত।

বেলা ১টা ৫ মিনিটের দিকে মিতু হত্যা মামলার কার্যক্রম শুরু হয়।

এসময় রাষ্ট্রপক্ষে পিপি মো. আবদুর রশিদ বলেন, “আজ অভিযোগ গঠন করা হতে পারে। যেহেতু মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে, তাই আসামিরা যেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকে মামলার বিচার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। অন্য মামলায় অন্য কোথাও নিতে হলে এখান থেকে নিয়ে যেন আবার আনা হয়।”

রাষ্ট্রপক্ষের শুনানির পর প্রায় ৪৫ মিনিট শুনানি করেন বাবুলেরর পক্ষে ঢাকা থেকে আসা আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

তিনি বলেন, “উনি (বাবুল) জেলে থাকা অবস্থায় পিবিআই দুটি মামলা দিয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। একটি মামলা করেছেন চট্টগ্রাম পিবিআই’র প্রধান। আরেকটি করেছেন সারাদেশের পিবিআই’র প্রধান।”

বাবুলের আরেক আইনজীবী কফিল উদ্দিন শুনানিতে বলেন, “পিবিআই ঢাকা চট্টগ্রামে সবখানে উনার বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে। এখানে কেন (চট্টগ্রাম কারাগারে)? তাহলে কোন উদ্দেশ্য আছে?”

এরপর অন্য আসামিদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন, শাহজাহান মিয়া ও কামরুল ইসলাম শিকদার মুছার পক্ষে আইনজীবীরা তাদের নির্দোষ দাবি করেন। বেলা ২টার দিকে আদালত মুলতবি করে অভিযোগ গঠন বিষয়ে বিকেল চারটায় আদেশ দেয়ার সময় নির্ধারণ করেন।

Also Read: মিতু হত্যায় স্বামী বাবুল আক্তারের বিচার শুরুর আদেশ

Also Read: পরকীয়া জেনে যাওয়ায় মিতুকে খুন করান স্বামী বাবুল: পিবিআই

Also Read: মিতু হত্যা: বাদী বাবুল আক্তার যেভাবে আসামি

বিকালে আদালতের কার্যক্রমের শুরুতে তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিন আসামির আইনজীবীর করা আবেদনে সোমবার বিকালে এডিসি প্রসিকিউশনের কক্ষে এক ঘণ্টা বাবুল আক্তারের সঙ্গে আলাপের অনুমতি দেন।

এরপর বাবুল আক্তারকে চট্টগ্রাম কারাগারে রাখতে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন বিষয়ে আদালত বলেন, “যেহেতু মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হচ্ছে তাই রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনটি মঞ্জুর করছি।”

এসময় কাঠগড়ায় থাকা বাবুল আক্তার বলেন, “আমার বক্তব্য আছে। চট্টগ্রামে আমি অনেকদিন চাকরি করেছি। সেসময় বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করেছি, এমন অনেক আসামি এখন দণ্ডিত হয়ে চট্টগ্রাম কারাগারে আছে।

“আর যেখানে (চট্টগ্রাম কারাগারে) আমাকে রাখা হয় সেখানে মৃত্যুদণ্ডের আসামিদের রাখা হয়। আমার মৃত্যুদণ্ড হয়নি।”

বাবুলের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ বলেন, “বর্তমানে উনাকে কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। তিনি ডিভিশনও পাননি। উনার সময়ে গ্রেপ্তার হয়ে দণ্ডিত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিও অনেকে এই কারাগারে আছেন।”

বাবুল এক সময় চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার ছিলেন। তিনি বদলি হয়ে যোগদানের জন্য ঢাকায় যাওয়ার পরপরই ২০১৬ সালের ৫ মে চট্টগ্রামে খুন হন তার স্ত্রী মিতু।

তখন বাবুল চট্টগ্রামে ফিরে খুনের মামলা করেছিলেন। পরে পিবিআইর তদন্তে বেরিয়ে আসে, বাবুলের পরিকল্পনায়ই খুন হয়েছিলেন মিতু।

এরপর ২০২১ সালের ১২ মে মিতুর বাবার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর পর শুরুতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন বাবুল। ওই মাসেই ২৯ তারিখে ফেনী কারাগারে নেওয়া হয়েছিল তাকে।

সেদিন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার দেওয়ান মো. তারিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, ‘অবস্থানগত কারণে ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে’ বাবুলকে ফেনী কারাগারে পাঠান হয়েছে।

গত বছরের ২২ মার্চ এই মামলায় হাতের লেখার নমুনা সংগ্রহ করতে বাবুলকে ফেনী থেকে চট্টগ্রাম কারাগারে আনা হয়।

সেদিন বাবুলের আইনজীবীরা তার ‘শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তার’ প্রয়োজনে তাকে ফেনী কারাগারে স্থানান্তরের আবেদন করলে আদালত কারাবিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। পরে ২৪ মার্চ তাকে ফেনী কারাগারে পাঠানো হয়।

এরপর থেকে মামলার ধার্য তারিখের আগে বাবুলকে ফেনী কারাগার থেকে চট্টগ্রাম কারাগারে আনা হচ্ছিল এবং মামলার কার্যক্রম শেষে আবার ফেনীতে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল।

সোমবার চট্টগ্রাম কারাগারে রাখার আদেশ দেওয়ার সময় বিচারক বলেন, “অসুবিধা হলে, অসুস্থ হলে বা নিরাপত্তা চাওয়ার সুযোগ আছে।”

তখন বাবুল বলেন, “এখন পর্যন্ত অনেকবার অসুস্থ হয়েছি... (এরপর তিনি কাঁদতে থাকেন) কিন্তু ডাক্তার দেখানোর সুযোগ হয়নি….”

বিচারক বলেন, “অসুস্থ হলে জেল কর্তৃপক্ষ আছে। তারা ব্যবস্থা নেবেন। কোর্টও দেখবে।”

তখন বাবুলের আইনজীবী বলেন, “উনার ঢাকাতেও মামলা আছে। ফেনীতে রাখে নিরাপত্তার জন্য।”

শেষে বিচারক বলেন, “মামলার বিচার কাজের জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে এ আদেশ দেওয়া হলো। চিকিৎসা বা অন্য কোনো বিষয়ে আপনারা জেল কর্তৃপক্ষ এবং প্রয়োজনে আদালতের কাছেও পরে আবেদন করতে পারবেন। অসুবিধা হলে আদালতের অনুমতি নিয়ে শিফট করতে পারে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তখন বিবেচনা করা হবে।”

এরপর বাবুল আক্তারের পক্ষে করা অব্যাহতির আবেদন নামঞ্জুর করে বাবুলসহ সাত আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ দেয় আদালত।

দ্রুত বিচারের প্রত্যাশা মিতুর বাবার

সোমবার অভিযোগ গঠনের শুনানির সময় আদালতে ছিলেন মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন।

শুনানিতে বাবুলের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “ভিকটিমের (মিতু) বাবা একটা মামলা করেছিলেন। তাদের (মিতু-বাবুলের) সন্তানরা চাচা ও দাদার কাছে আছে।”

এসময় আদালত জানতে চান মিতু-বাবুলের সন্তানরা নানা বাড়িতে যায় কি না? জবাবে শিশির মনির বলেন, “হ্যাঁ।”

তখন মোশাররফ হোসেন বলেন, “আমার বাড়িতে নাতি-নাতনিদের যাতায়াত নেই।”

এরপর আদালত জানতে চাইলে বাবুলের আইনজীবী জানান, মিতু-বাবুলের সন্তানরা দাদা ও চাচার সঙ্গে ঢাকায় আছেন।

অভিযোগ গঠনের পর জানতে চাইলে মিতুর বাবা মোশাররফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করায় সন্তুষ্ট। এখন চাই দ্রুত সাক্ষ্য-জেরা শেষে যেন রায় হয়।”

তিনি বলেন, “মিতু হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। নিজেকে আড়াল করতে তড়িঘড়ি করে বাবুল মামলা করেছিল।”

হত্যাকাণ্ডের প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় ২০২১ সালের ১১ মে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চট্টগ্রাম পিবিআই কার্যালয়ে ডেকে আনা হয়।

এর পরদিন ১২ মে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, মিতু হত্যার সঙ্গে তার স্বামী বাবুল আক্তারের ‘সম্পৃক্ততার প্রমাণ’ পেয়েছেন তারা।

ঢাকায় ওই সংবাদ সম্মেলনের পরপরই চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় যান মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন। বাবুলকে প্রধান আসামি করে আটজনের বিরুদ্ধে নতুন একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন তিনি।

তবে আইনি জটিলতা দেখা দেওয়ার পর ওই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। টিকে থাকে বাবুলের করা মামলাটি।

বাবুলের করা সেই মামলায় তদন্ত শেষে গত বছর ১৩ সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্র জমা দেয় পিবিআই। তাতে বাবুলসহ সাতজনকে আসামি করা হয়। পরের মাসে ১০ অক্টোবর সেই অভিযোগপত্র গ্রহণ করে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত। পাঁচ মাস পর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রায় সাত বছর পর আলোচিত এই মামলার বিচার শুরু হল।