টি শার্টের লোগো আর মুখের দাড়ি জানাল, লাশটি ফায়ারম্যান রানা মিয়ার

অঙ্গার দেহের এক পায়ে আধপোড়া বুট জানান দিচ্ছিল, তিনি ফায়ার সার্ভিসেরই কর্মী, কিন্তু এ বাহিনীর একাধিক কর্মী নিখোঁজ হওয়ায় তার পরিচয় নিয়ে দেখা দেয় বিভ্রান্তি।

মিন্টু চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 June 2022, 11:39 AM
Updated : 5 June 2022, 04:37 PM

শেষ পর্যন্ত পোড়া শরীরে থাকা টি শার্টে গ্রামের ক্লাবের লোগো আর মুখের দাড়ি দেখে স্বজনরা নিশ্চিত হন, তিনি ফায়ারম্যান রানা মিয়া।

রোববার সকালে ওই দেহটি নিপন চাকমার বলে দাবি করেছিলেন তার ভাই খোকন চাকমা। সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের ফায়ার লিডার ৪৩ বছর বয়সী নিপন চাকমাও শনিবার রাতে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন নেভাতে গিয়ে নিখোঁজ হন।

দুপুরে একই দেহকে নিজের শ্যালক ফায়ার ম্যান রানা মিয়া হিসেবে শনাক্ত করেন বিজিবি সদস্য রাসেল শেখ। ২৪ বছর বয়সী রানা মিয়া কুমিরা ফায়ার স্টেশনে কর্মরত ছিলেন। তিনিও আগুন নেভাতে গিয়ে নিখোঁজ হন।

পরে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের কর্মকর্তারা লাশটিকে রানা মিয়ার বলে নিশ্চিত হন। কারণ নিপন চাকমার মুখে দাড়ি ছিল না।

রানা মিয়ার বোনের স্বামী বিজিবি সদস্য রাসেল শেখ জানান, রানা মিয়ার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের শিবালয়ে। স্থানীয় নবগ্রাম উদয়ন ক্লাবের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ছিল। পোড়া লাশের শরীরে ওই ক্লাবের টি শার্ট বেঁচে গিয়েছিল কিছুটা। তাতে ওই লোগো দেখেই তিনি নিশ্চিত হন- এটা রানা মিয়ার লাশ।

শিবালয়ে গত ২৭ মে স্থানীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টে পুরস্কার নিচ্ছেন রানা (বাম থেকে তৃতীয়)

তাছাড়া রানার মুখে দাড়ি ছিল; পুড়ে যাওয়া মুখে এক গোছা দাড়িও দেখার কথা জানালেন রাসেল শেখ। 

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বায়তুল ইজ্জত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কর্মরত এই বিজিবি সদস্য বলেন, সকালে তারা জানতে পারেন যে রানা মিয়া আগুন নেভাতে গেছেন। দুই বছর আগে ফায়ার সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন রানা। প্রশিক্ষণের পর কুমিরা ছিল তার প্রথম কর্মস্থল।

এদিকে রানার প্রাণহানির কথা কার মা এখনও জানে না বলে জানিয়েছেন প্রতিবেশী ও শিবালয় ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মনির হোসেন। তিনি রোববার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোরকে বলেন, “রানার বাবা পান্নু মিয়া ঢাকা থাকেন। রানারা তিন ভাইবোন।

“তার ছোট এক ভাই আর বোন আছে। তার ছোট ভাই আর মা জানে না রানা নিহত হয়েছে।”

রানার বাবার বাড়ি শিবালয়ের তেওতা এলাকায় হলেও নানা বাড়ি নবগ্রামেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। সেখানেই থাকে পরিবারের অন্য সদস্যরা। স্থানীয় নবগ্রাম উদয়ন ক্লাবের সদস্য রানা কয়েক দিন আগেই গ্রামে গিয়েছিলেন। গত ২৭ মে স্থানীয় আবরার ওয়াহিদ জিনান ক্রিকেট টুর্নামেন্ট তার দল রানার্সআপ হয়।

গ্রামে ছুটি কাটিয়ে গেল বৃহস্পতিবারই রানা কর্মস্থলে ফেরেন জানিয়ে ইউপি সদস্য মনির বলেন, “শান্ত স্বভাবের ছেলে সে। গ্রামে আসলে ক্রিকেট-ফুটবল খেলার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজ করতো।

“ঘটনা শুনে রানার এক মামা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে গেছেন।তবে তার মা অসুস্থ থাকায় তাকে এখনও বিষয়টা কেউ বলেনি।”

নিজের এলাকায় ফুটবল অনুশীলনে রানা (ডানে)

নবগ্রাম উদয়ন ক্লাবের সভাপতি মুন্না মুনসী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রানা ১৪-১৫ বছর ধরে এ ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত।ও ক্রিকেট, ফুটবল খেলায় সমান পারদর্শী ছিল।

“শুক্রবার (২৭ মে) ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা ছিল। ওই দিন আমার হাত থেকে পুরস্কার নেয় ও।” 

শিবালয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাল উদ্দিন আলাল বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোরকে বলেন, “আমার ইউনিয়নের নবগ্রাম গ্রামের রানা নামের ফায়ার সার্ভিসের সদস্য গতকাল রাতে সীতাকুণ্ডে কন্টেইনার ডিপোর আগুন নেভাতে গিয়ে নিখোঁজ হন। আজ তার মরদেহ শনাক্ত হয়েছে।”

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পুড়ে যাওয়া মৃতদেহ রাখা রয়েছে। লাশ শনাক্তের জন্য সেখানে সহায়তা করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

চট্টগ্রাম জেলা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মনির হোসেন রোববার দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চট্টগ্রাম মেডিকেলে মোট ৪১টি লাশ আছে। প্রাথমিকভাবে পরিবারের সদস্য এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের মাধ্যমে ১৭টি লাশ শনাক্ত করা হয়েছে। অনেকগুলো লাশ পুড়ে যাওয়ায় ঠিকমতো শনাক্ত করা যাচ্ছে না।

“যে লাশগুলো নিয়ে কনফিউশন দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া গেলে তা রাখা হবে এবং ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে। শনাক্ত হওয়া ১৭টি লাশ সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে।”

(এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি মাহিদুল ইসলাম মাহি)

আরও পড়ুন: