গৃহকর বাড়ানোর সুযোগ পেল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের ওপর চার বছর আগের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Jan 2022, 08:53 AM
Updated : 19 Jan 2022, 10:49 AM

সেইসঙ্গে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গৃহকরের যে হার নির্ধারণ করা হয়েছিল, সে অনুযায়ী কর আদায়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম সিটির ব্যক্তিমালিকানাধীন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হোল্ডিংয়ের জন্য এই সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। এরআগে ২০২০ সালের শেষ দিকে সরকারি হোল্ডিংয়ের ক্ষেত্রেও একই সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছিল।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-সচিব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম সাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠি মঙ্গলবার সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়।

চিঠিতে বলা হয়, “চট্টগ্রাম মহানগরীতে গত ১০ বছর পূর্বের নির্ধারিত হারে জনসাধারণ কর প্রদান করছে। এতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হতে বঞ্চিত হচ্ছে। জনসাধারণের নাগরিক সেবা ও বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড গতিশীল রাখাসহ করপোরেশনের আয় বৃদ্ধির স্বার্থে ব্যক্তিমালিকানাধীন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হোল্ডিং সমূহের বিগত ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের প্রথম কোয়ার্টারের প্রকাশিত গৃহকর-পুনর্মূল্যায়নের আলোকে গৃহকর আদায়ের পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।”

চার বছর আগে সিটি করপোরেশন ব্যক্তিমালিকানাধীন স্থাপনার কর বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে আন্দোলনের মুখে তা স্থগিত করেছিল মন্ত্রণালয়। গত ২ জানুয়ারি ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল সিটি করপোরেশন।

এতে নগরবাসীর ভয়ের কিছু নেই মন্তব্য করে মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বুধবার বলেছেন, “হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানো হবে না, শুধু করের আওতা বাড়ানো হবে।”

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ধরেন, আপনার যদি একতলা বাড়িটি একতলাই থাকে, তাহলে আগে যা দিতেন সেই হোল্ডিং ট্যাক্সই দেবেন। কিন্তু যদি সেটি চার-তলা হয়, তাহলে বাকি তিন-তলার ট্যাক্সটা তো দেবেন।”

সিটি নির্বাচনের আগে ইশতেহারে ‘বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়া কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেভাবে যৌক্তিক হারে গৃহকর নির্ধারণ করার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।

তবে এরকম আশ্বাসে সন্তুষ্ট নয় চট্টগ্রামের ‘করদাতা সুরক্ষা পরিষদ’ যাদের আন্দোলনে ২০১৭ সালে হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছিল।

পরিষদের নেতারা বলছেন, ২০১৭-১৮ সালের মূল্যায়ন অনুসারে বর্ধিত কর দেওয়া নগরবাসীর পক্ষে সম্ভব নয়। বর্তমান মেয়র এ বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করছেন না।

হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে আগের মেয়রের মেয়াদে যে মূল্যায়ন ছিলো সেটা বাস্তবায়ন করা হলে আবারও আন্দোলন হবে বলে হুমকি দিয়েছেন তারা।

আগে অসঙ্গতি হয়ে থাকলে আপিল করার পরামর্শ দিয়ে চট্টগ্রামের মেয়র বলেন, “আপিল করলে তা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা হবে। ইতোমধ্যে যারা আবেদন করেছেন সেগুলো সহনীয় করা হয়েছে। তাই মানুষ অসন্তোষ প্রকাশ করছে না। একই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে।”

বকেয়া না করে নিয়মিত কর পরিশোধের আহ্বান জানিয়ে মেয়র রেজাউল বলেন, “ট্যাক্স নিয়ে মানুষের বিড়ম্বনা ভোগান্তি ও আতঙ্ক থাকবে না। আগে অতিরিক্ত দাবি করাতেই স্থগিতাদেশ দেয়া হয়েছিল।”  

২০১৭-১৮ অর্থবছরের হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের বিরোধিতাকারী সংগঠন চট্টগ্রামের করদাতা সুরক্ষা পরিষদের মুখপাত্র হাসান মারুফ রুমী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সময়ে করা পুনর্মূল্যায়নের বিরুদ্ধেই আমরা আন্দোলন করেছিলাম। এখন স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার মানে তো সেই অনুসারেই হোল্ডিং ট্যাক্স নেওয়া হবে।

“বর্তমান মেয়র যে বলছেন, আওতা বাড়বে কিন্তু হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়বে না- সেটা মিথ্যাচার। আগের করা সেই এসেসমেন্ট অনুসারে কর নিতে আসলে মানুষ আবার আন্দোলনে নামবে। অথচ নির্বাচনের আগে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কর বাড়বে না। তিনি বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিলে নগরবাসীর তো ওনার ওপরে আস্থা থাকবে না।”

হাসান মারুফ রুমী বলেন, “বর্তমান মেয়রের প্রতি আহ্বান জানাব, তিনি অবস্থান পরিষ্কার করুক। কী করবেন তা স্পষ্টভাবে বলুক। আগের এসেসমেন্টের হারে কর চট্টগ্রামের মানুষ দিতে পারবে না। আবার আন্দোলন হবে।”

সিটি করপোরেশন সমূহের (কর) বিধি ১৯৮৬ এর ২১ বিধি অনুসারে পাঁচ বছর পরপর কায়িক অনুসন্ধানের মাধ্যমে গৃহকর পুনর্মূল্যায়নের এখতিয়ার সিটি করপোরেশনগুলোকে দেয়া হয়েছে।

সে অনুসারে ২০১৬-১৭ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন গৃহকর-পুনর্মূল্যায়নের কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল। ২০১৬ সালের মার্চে ‘পঞ্চবার্ষিকী কর মূল্যায়ন কর্মসূচি’র মধ্য দিয়ে নতুন করে হোল্ডিং এর কর নির্ধারণ শুরু করেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। মূল্যায়ন শেষে ওই বছরের ৩১ অগাস্ট তা প্রকাশ করা হয়।

ওই মূল্যায়নে ১ লাখ ৮৫ হাজার ২৪৮টি সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন স্থাপনা নির্ধারণ হয়, যা আগের মূল্যায়নের হোল্ডিং এর চেয়ে ২৮ হাজার ৭০২টি বেশি। এসব স্থাপনার বিপরীতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮৫১ কোটি ৩০ লাখ ৬৪ হাজার টাকা গৃহকর নির্ধারণ করেছিলেন মেয়র নাছির।

বিভিন্ন মহলের বিরোধিতার কারণে ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগ তা স্থগিত করার নির্দেশনা দেয়ায় তা আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। পরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় হোল্ডিং ট্যাক্স কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় এনে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কর পুনর্মূল্যায়ন স্থগিত রাখতে এবং আগের এসেসমেন্ট অনুসারে গৃহকর আদায়ের নির্দেশ দেয়।

বর্তমানে বন্দর নগরীতে ২০১০-১১ অর্থবছরের পঞ্চবার্ষিক কর পুনর্মূল্যায়ন অনুসারে নির্ধারিত হারে কর আদায় করা হয়। পুরনো নিয়মে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সিসিসির হোল্ডিং ট্যাক্স বাবদ আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩৪৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে আদায় হয়েছিল ১০৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

নতুন কর মূল্যায়নের পর থেকেই নগরবাসী অতিরিক্ত হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলে। নতুন পদ্ধতিতে ভাড়ার ভিত্তিতে হোল্ডিং ট্যাক্সের পরিবর্তে আগের নিয়মে স্থাপনার আয়তন হিসেবে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ ও আদায়ের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে করদাতা সুরক্ষা পরিষদ।

প্রয়াত নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ দলীয় নেতারাও পরে বিরোধিতা করেন মেয়র নাছিরের ওই উদ্যোগের।

আগে স্থাপনার আয়তনের (বর্গফুট) ভিত্তিতে হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ করতে হতো। সিসিসি ২০১৭ সালে নতুন করে যে ১৭ শতাংশ হারে কর নির্ধারণ করেছিল তার মধ্যে ৭ শতাংশ হোল্ডিং বাবদ, ৩ শতাংশ বিদ্যুতায়ন বাবাদ এবং আর্বজনা অপসারণের জন্য ৭ শতাংশ।

ওই পুনর্মূল্যায়ন অনুসারে, যে কোনো বহুতল স্থাপনার সবগুলো ফ্ল্যাটের মোট বার্ষিক ভাড়া থেকে দুই মাসের ভাড়া বাদ যাবে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হিসেবে। ভবন মালিক যদি ঘর ভাড়া না দিয়ে শুধুমাত্র নিজেই বসবাস করেন সেক্ষেত্রে আরও ৪০ শতাংশ ছাড় দেয়া হবে।

এরপর বার্ষিক ভাড়ার যে মোট অঙ্ক বাকি থাকবে তার ওপর ১৭ শতাংশ কর দিতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর -