জবানবন্দি দিলেন না বাবুল, কেন?

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিতে বাবুল আক্তারকে হাকিমের কাছে নিয়েছিল পিবিআই; কিন্তু সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসায় বিফল হয়েছে সেই চেষ্টা। পুলিশ হেফাজত থেকে আদালত হয়ে এখন কারাগারে গেছেন স্ত্রী হত্যামামলার এই আসামি।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 May 2021, 04:45 PM
Updated : 17 May 2021, 05:36 PM

তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যামামলায় সাবেক এসপি বাবুল আক্তার হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে রাজি হয়েছিলেন।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের এক সময়ের অতিরিক্ত উপকমিশনার বাবুলকে নিয়ে সোমবার চট্টগ্রাম মহানগর আদালত এলাকায় কিছুটা নাটকীয়তাই হয়। তাকে সকালে আদালতে আনা হলেও তা গোপন রাখা হয়।

প্রায় চার ঘন্টা আদালতে অবস্থান এবং একজন বিচারকের খাস কামরায় বেশ কিছুক্ষণ থাকলেও এই হত্যাকাণ্ডের বাদী থেকে আসামিতে পরিণত হওয়া বাবুল আক্তার জবানবন্দি দেননি; যাকে পুলিশ বলছে ‘শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্ত বদল’।

তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিনি (বাবুল) জিজ্ঞাসাবাদে যা বলেছেন, সেসব বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার কথা ছিল। সেজন্য রিমান্ডের আবেদন ছাড়াই আদালতে পাঠানো হয়। তবে মত পরিবর্তন করে তিনি আর জবানবন্দি দেননি।”

বাবুল জবানবন্দি দেবেন ধরে নিয়ে পুলিশ নতুন করে আর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড আবেদন করেনি আদালতে।

সোমবার চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (প্রসিকিউশন) কাজী সাহাবুদ্দিন আহমদ বলেন, “উনাকে (বাবুল) ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে বলা হলেও তিনি তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। আমরা কোনো রিমান্ডের আবেদন করিনি। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।”

বাবুল আক্তারের আইনজীবী আরিফুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু উনাকে (বাবুল) ১৬৪ করাতে এনেছেন, তাই রিমান্ড পিটিশন আনেনি। যদি উনারা (পিবিআই) জানতেন যে, উনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেবেন না তাহলে তারা রিমান্ড পিটিশন সঙ্গে আনতেন।”

মাহমুদা আক্তার মিতু

মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনের করা নতুন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১২ মে বাবুল আক্তারকে প্রথম আদালতে হাজির করা হয়।

সেদিনও জবানবন্দি দেওয়ার বিষয়ে তিনি মত বদলে ফেলেছিলেন বলে জানান মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।  

এই প্রশ্নের উত্তর যিনি দিতে পারতেন সেই বাবুল আক্তারকে সোমবার হাকিমের খাস কামরা থেকে বের হওয়ার সময় তিনি কিছু বলতে চাইলেও পুলিশ সেই সুযোগ দেয়নি।

বাবুলকে সোমবার আদালতে হাজির করা, তাকে এই ক’দিন জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য এবং জবানবন্দি দেওয়া কিংবা সিদ্ধান্ত বদলের বিষয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি নন পিবিআইর কর্মকর্তারা।

কেন বাবুল জবানবন্দি দেননি, সে বিষয়ে তার আইনজীবী আরিফুর রহমানও কিছু বলতে পারেননি। 

সতর্কতা-লুকোছাপা

পাঁচ দিন পিবিআই হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বাবুল আক্তারকে চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হয়।

যদিও গণমাধ্যমকর্মীরা খবর পেয়েছিলেন যে তাকে সাড়ে ১২টা-১টার দিকে আদালতে নেওয়া হতে পারে।

সকালের ভাগে তাকে আদালতে হাজির করা, পরবর্তী আইনগত প্রক্রিয়া, কোন বিচারকের আদালতে নেওয়া হবে- এসব বিষয়ে পিবিআই ও উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা ছিলেন নিরুত্তর।

সকাল সাড়ে ১০টা থেকে প্রায় চার ঘণ্টা আদালত প্রাঙ্গণে পিবিআই, নগর পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যদের বেশ সতর্ক দেখা গিয়েছিল।

গণমাধ্যমকর্মীরা পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, অনেক আগেই বাবুল আক্তারকে আদালতে আনা হয়েছে।

সকালেই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের জন্য পিবিআইর পক্ষ থেকে আদালতে লিখিত আবেদন জানানো হয়। এরপর বাবুলকে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার জাহানের খাস কামরায় নেওয়া হয়।

এসময় খাস কামরার বাইরে বাবুলের আইনজীবী আরিফুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

বেলা আড়াইটার দিকে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট ও প্রসিকিউশন শাখার দুয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা খাস কামরায় যান।

এর পরপরই পুলিশ সদস্যরা দুই সারিতে দাঁড়িয়ে কামরায় বাইরের অংশ ঘিরে ফিলেন।

বেলা পৌনে ৩টার দিকে বাবুল আক্তার খাস কামরা থেকে বেরিয়ে আসেন।

কালো পাঞ্জাবি পরা বাবুল আক্তারকে তখন খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। এসময় তিনি কিছু বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশ ঘিরে থাকায় কথা বলার সুযোগ পাননি। তারপর দ্রুত গতিতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়।

আদালত থেকে কারাগারের পথে বাবুল আক্তার। ছবি: সুমন বাবু

পুলিশ সদস্যরা যখন বাবুলকে নিয়ে নিচে অপেক্ষমান প্রিজন ভ্যানে তুলছিল, তখন পিবিআই সদস্যরা আদালত প্রাঙ্গণ ছেড়ে যায়।

তখনও পিবিআই বা প্রসিকিউশন শাখার পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি, বাবুল আক্তার জবানবন্দি দিয়েছেন কিনা অথবা তাকে রিমান্ডে চাওয়া হবে কি না?

পরে বাবুল আক্তারের আইনজীবী আরিফুর রহমান জানান, নতুন করে রিমান্ডের কোনো আবেদন না থাকায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, “আদালতের কাছে সাবেক সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আমরা তার ডিভিশনের আবেদন করলে বিচারক কারাবিধি অনুসারে ব্যবস্থা নিতে সিনিয়র জেল সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন।”

সোমবার জামিনের আবেদন করা হয়নি জানিয়ে আইনজীবী আরিফুর বলেন, “১২ মে প্রথমদিনই আমরা জামিনের আবেদন করলে তা নামঞ্জুর হয়। সেই আদেশের কপি পেলে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”

এরআগে সকালে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পিবিআই কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, জিজ্ঞাসাবাদের শুরুর কয়েকদিন মুখ খোলেননি বাবুল। বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব দিলেও কিছু প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন।

তবে মিতু হত্যার আসামি কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা যে বাবুলের ‘সোর্স’ ছিলেন, সে কথা তিনি জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন বলে তদন্ত কর্মকর্তার দাবি।

এমনকি মিতু হত্যার কারণ সম্পর্কিত প্রায় সব প্রশ্নই এড়িয়ে গিয়ে বাবুল বলেছেন, সবকিছু যেহেতু তদন্তকারীরা জানে সেহেতু তদন্ত করেই বের করা হোক।

পাঁচ বছর আগে চট্টগ্রামে প্রকাশ্য সড়কে খুন হন বাবুলের স্ত্রী মিতু। তখন বাবুল একটি মামলা করেছিলেন। নানা নাটকীয়তার মধ্যে পুলিশের চাকরিও ছাড়তে হয় তাকে।

পিবিআই এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তভার নেওয়ার এক বছর পর স্ত্রী হত্যাকাণ্ডে বাবুলের সম্পৃক্ততা পাওয়ার কথা জানায়। তাকে চট্টগ্রামে ডেকে নেওয়া হয়। পরে শ্বশুর নতুন মামলা করলে সেই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।