মিতু হত্যায় স্বামী বাবুল আক্তার ‘জড়িত’: পিবিআই

পাঁচ বছর আগে চট্টগ্রামে মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার স্বামী সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের ‘সম্পৃক্ততার প্রমাণ’ পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 May 2021, 06:08 AM
Updated : 12 May 2021, 12:52 PM

এ তদন্ত সংস্থার প্রধান, পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার বুধবার ঢাকার ধানমন্ডিতে পিবিআই সদরদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, “মিত্যু হত্যার সঙ্গে স্বামী বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। এ জন্য তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।”

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় সড়কে খুন হন পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু।

পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদরদপ্তরে যোগ দিতে ওই সময় ঢাকায় ছিলেন বাবুল। তার ঠিক আগেই চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশে ছিলেন তিনি।

হত্যাকাণ্ডের পর নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন বাবুল আক্তার নিজেই।

সেই মামলায় পুলিশ ‘চূড়ান্ত প্রতিবেদন’ দেবে জানিয়ে পিবিআই প্রধান বলেন, “মিতুর বাবা বাদী হয়ে বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে মামলা করবেন। এজাহার প্রস্তুত করা হয়েছে।"

বাবুল আক্তার

এক সময় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে উপকমিশনারের দায়িত্ব পালন করা বাবুল আক্তার মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রামে পিবিআইয়ের মেট্রো অঞ্চলের কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখী হওয়ার পর থেকেই তদন্তকারীদের হেফাজতে আছেন।

আগের মামলার বাদী হিসেবেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় জানিয়ে বনজ কুমার মজুমদার বলেন, "বাদী হিসাবে তার দায়ের করা মামলায় আইন অনুযায়ী তাকে গ্রেপ্তার করা যায় না। তার দায়ের করা মামলা ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হবে।"

হত্যাকাণ্ডের পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে বাবুলকে নিয়ে সন্দেহের কথা বলতে শুরু করেন তার শ্বশুর মোশাররফ।

তিনি বলেছিলেন, “এখন যেসব শুনছি, তার কিছুটাও যদি সত্য হয় তাহলে তো বুঝব, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বাবুল আমার বাসায় থেকে অভিনয় করেছে।

“আসলে তখন তো আপনারা তাকে প্রশ্ন করতে পারেন নাই। আমিই আপনাদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। আসলে ভুলটা আমারই হয়েছে। এটা তার এক ধরনের কৌশল ছিল।”

কেন বাবুলকে সন্দেহ- তার জবাবে তিনি বলেছিলেন, বাবুলের অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বলে তার মেয়েকে খুন হতে হয়েছে।

চট্টগ্রামে গিয়ে আগের তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা বলেছিলেন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন ও মা সাহেদা মোশাররফ নীলা।

স্ত্রী খুন হওয়ার পর স্বজনদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার (সামনে মাঝে)।

পুলিশ এখন মিতুর পরিবারের সন্দেহের সত্যতা পেয়েছে জানিয়ে বনজ কুমার মজুমদার বলেন, “পিবিআই দায়িত্ব নেওয়ার পর তদন্ত ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। প্রথমে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা আসেনি, পরে তার বন্ধু গাজী আল মামুন ও সাইফুল হক আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

“এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে বাবুল আক্তারই তার স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনাকারী এবং নির্দেশদাতা।”

পিবিআই প্রধান বলেন, ঘটনাস্থলের কাছ থেকে সংগ্রহ করা সিসিটিভি ভিডিওতে একজনকে দেখা গিয়েছিল, পরে জানা যায় সে বাবুল আক্তারের ‘সোর্স’ কামরুল ইসলাম সিকদার মুসা।

“ভিডিও ফুটেজ স্পষ্ট মুসাকে চেনা গেছে। কিন্তু তদন্তে ও জিজ্ঞাসাবাদে মুসাকে নিয়ে বাবুল আক্তার কোনো সন্দেহের কথা বলেনি।

“পরে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছি যে বাবুল আক্তার ইচ্ছাকৃতভাবে তার ব্যক্তিগত সোর্স মুসাকে নিয়ে পুলিশকে কিছু জানায়নি।"

মিতু হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে আহত হওয়ার কথা বলেছিলেন বাবুল।

পুলিশ তখন সেটাই ‘বিশ্বাস করেছে’ জানিয়ে বনজ কুমার বলেন, "আবার স্ত্রী মিতু নিহতের পর যে তার আচরণ ছিল, তা ছিল সবচেয়ে আপনজন হারানোর মত। তাই তার কথা সবাই বিশ্বাস করেছিলেন।"

গত সোমবার পিবিআইয়ের ঢাকা অফিসে বাবুল আক্তারকে ডাকা হয়েছিল জানিয়ে বনজ কুমার বলেন, “সাক্ষাতের পর বাবুল আক্তার পিবিআইয়ের কিছু প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। বিষয়গুলো আইজিপিকে জানানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও জানানো হয়। এ অবস্থায় ব্যাক করার সুযোগ নেই।"

ঘটনাক্রম

## ২০১৬ সালের ৫ জুন: সকালে খুন হন মাহমুদা আক্তার মিতু

## ৬ জুন: চকবাজার বড় গ্যারেজ এলাকা থেকে পুলিশ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটর সাইকেলটি উদ্ধার করে। ওই দিন বাবুল আক্তার বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় হত্যামামলা করেন।

## ৮ জুন ও ১১ জুন: গোয়েন্দা পুলিশ হাটহাজারি উপজেলা থেকে আবু নসুর গুন্নু ও বায়েজিদ বোস্তামী থানার শীতল ঝর্ণা থেকে শাহ জামান ওরফে রবিন নামে দুজনকে গ্রেপ্তারের খবর জানায়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মিতু হত্যাকাণ্ডে এই দুজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।

## ২৪ জুন: ঢাকার বনশ্রীর শশুর বাসা থেকে বাবুল আক্তারকে ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে নিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

## ২৬ জুন: মো. আনোয়ার ও মো. মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম নামে দুজনের গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশ করে পুলিশ। ওইদিন তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

## ২৮ জুন: বাবুল আক্তারের অন্যতম সোর্স এহেতাশামুল হক ভোলা ও তার সহযোগী মো. মনিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে পয়েন্ট ৩২ বোরের একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। যেটি মিতু হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত হয় বলে পুলিশের দাবি।

## ১ জুলাই: মোটর সাইকেল সরবরাহ করার অভিযোগে মুছার ভাই সাইদুল আলম শিকদার ওরফে সাক্কু ও শাহজাহান নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

## ৪ জুলাই: মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে মুছাকে আদালতে হাজির করার দাবি করেন। ২২ জুন বন্দর থানা এলাকায় তাদের এক পরিচিত জনের বাসা থেকে মুছাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

## ৫ জুলাই: ভোরে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ঠান্ডাছড়িতে নুরুল ইসলাম রাশেদ ও নুরুন্নবী নামে দুইজন পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

## ১৩ অগাস্ট স্ত্রীকে নিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নিজের নিরবতা ভাঙেন বাবুল আক্তার।

## ৬ সেপ্টেম্বর বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

## ১ নভেম্বর: ঢাকার বেসরকারি আল-দ্বীন হাসপাতালে সহযোগী পরিচালক হিসেবে বাবুল আক্তার যোগদান করেন।

## ২২ নভেম্বর: ভোলা ও মনিরকে অভিযুক্ত করে পুলিশের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে গ্রহণ।

## ১৫ ডিসেম্বর: তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে চট্টগ্রাম আসেন বাবুল আক্তার।

## ২০১৭ সালের জানুয়ারি: বাবুলের বাবা-মা ও শ্বশুর মোশারফ হোসেন ও শ্বাশুড়ি সাহেদা মোশারফ নীলা চট্টগ্রাম এসে দেখা করেন তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে।

## ১৪ ফেব্রুয়ারি: ভোলার লালমোহন এলাকা থেকে মিতুর মোবাইল ফোনের সিম উদ্ধার করে গোয়েন্দা পুলিশ।

## ২০২০ সালের জানুয়ারি: আদালত মামলাটির তদন্তের ভার পিবিআইকে দেয়।