এক বছরেও জানা গেল না সুদীপ্তকে কারা কেন মারল

বছর ঘুরলেও চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাস কেন খুন হলেন, কারাই বা এর পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন, তার কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।

উত্তম সেন গুপ্ত চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Oct 2018, 02:02 PM
Updated : 5 Oct 2018, 02:02 PM

সুদীপ্তকে হত্যায় বিচ্ছিন্নভাবে গণমাধ্যমে কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান ছাত্রলীগ নেতার নাম জড়িয়ে খবর এসেছে, হত্যার ঘটনায় ১১ জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে, কিন্তু কোনো কূলকিনারা এখনো হয়নি। 

ছেলের হত্যার বিচার পাবেন কিনা তা নিয়ে এক বছরে শুধু হতাশা ও শঙ্কাই বেড়েছে সুদীপ্তর বাবা বাবুল বিশ্বাসের মনে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পুলিশ যাদের ধরেছে তাদের অনেকের স্বীকারোক্তি নিতে পারেনি। অনেকেই আবার জামিন নেওয়ার পাঁয়তারা করছে। রাজনৈতিক কারণে সুষ্ঠু বিচার পাওয়া নিয়ে আমরা শঙ্কিত।”

চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের শিক্ষার্থী সুদীপ্ত নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমুর সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

গত বছরের ৬ অক্টোবর সকালে দক্ষিণ নালাপাড়ার বাসা থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে খুন করা হয় নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে। এ ঘটনায় সুদীপ্তর বাবা সদরঘাট থানায় অজ্ঞাত সাত-আটজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।

সুদীপ্তর বাসা দক্ষিণ নালাপাড়া এলাকায় ঢোকার আগে মোটর সাইকেলে হত্যাকারীরা, আরোহী তিনজনের মধ্যে শেষের সাদা স্ট্রাইপে কালো টি-শার্ট পরা মোক্তার।

হত্যাকাণ্ডের পর মহানগর ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানিয়েছিলেন, বিগত কয়েক দশক ধরে সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সমর্থকরা থাকলেও কয়েক বছর ধরে তার বিপরীতে একটি অংশ দাঁড়িয়েছে, যাদের একাংশের নেতৃত্বে আছেন কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, বর্তমানে নগরীর লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম।

এই মাসুমের অনুসারীরাই সুদীপ্তকে পিটিয়ে মেরেছে বলে শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছে নগর ছাত্রলীগের একাংশ।

এই হত্যা মামলায় বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার ১১ জনই মাসুমের সমর্থক হিসেবে পরিচিত। আর মাসুম সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি থাকার সময়ে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সমর্থক হিসেবে পরিচিতি হলেও ২০১৪ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর তিনি মেয়র আ জ ম নাছিরের বলয়ে চলে আসেন।

নিজেদের মধ্যেকার বিরোধ নিয়ে ফেইসবুকে লেখালেখির কারণে মাসুমের বিরাগভাজন হয়ে সুদীপ্ত খুন হন বলেও তার ঘনিষ্টজনদের ধারণা।

‘বড় ভাইদের নির্দেশে’ সুদীপ্তকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন মোক্তার হোসেন

এদিকে সুদীপ্ত হত্যার অন্যতম ‘পরিকল্পনাকারী’ হিসেবে আলোচিত আইনুল কাদের নিপু গত ১৭ সেপ্টেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠান।

এর আগে সুদীপ্ত হত্যায় গ্রেপ্তার ১১ আসামির আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন মোক্তার ও পাপ্পু নামের দুইজন।

গ্রেপ্তার মোক্তার জবানবন্দিতে জানিয়েছিলেন, হত্যাকাণ্ডের আগের দিন ৫ অক্টোবর রাতে আইনুল কাদের নিপুর নির্দেশে তারা লালখান বাজারে কর্নেল হোটেলের পাশে শাহী গলিতে জড়ো হয়েছিলেন। সেখানে নিপু তাদেরকে পরেরদিন ভোরে লালখান বাজার এলাকায় দলবল নিয়ে আসতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সে অনুযায়ী তারা ভোরে লালখান বাজার নিপুর নির্দেশনা মত কয়েকটি অটোরিকশা ও তিনটি মোটর সাইকেলে করে দক্ষিণ নালাপাড়ায় সুদীপ্তর বাসায় তারা যান।

পুলিশ জানিয়েছিল, অন্তত ১৫টি অটোরিকশা ও তিনটি মোটর সাইকেলে করে সুদীপ্ত হত্যায় অংশ নিয়েছিল হত্যকারীরা।

ওই জবানবন্দির পর থেকেই থমকে আছে মামলার গতি।

আসামিদের জবানবন্দিতে যাদের নাম এসেছিল তাদের একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র রুবেল দে ওরফে চশমা রুবেল গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। কিন্তু হেফাজতে এনে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলেও আদালতে তাকে স্বীকারোক্তি দেওয়াতে আবেদনই করেনি পুলিশ। আইনুল কাদের নিপুর জবানবন্দিও নিতে পারেনি পুলিশ।

ফয়সাল আহম্মেদ পাপ্পু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন

রুবেল দে চবির শিক্ষার্থী তাপস সরকার হত্যা মামলারও অন্যতম আসামি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সদরঘাট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রুহুল আমিন বলেন, “আমরা মামলার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। ১১ আসামির মধ্যে দু’জন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।

“বাকী যাদের দরকার তাদের মধ্যে নিপুসহ আরও কয়েকজনের জবানবন্দির জন্য আদালতে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু তারা রিমান্ডে অনেক কিছু স্বীকার করার পরও জবানবন্দি দিতে আদালতে গিয়ে পরে আর দেয়নি।”

নগর ছাত্রলীগ সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১১ জন গ্রেপ্তার হলেও এখনো নির্দেশদাতা ও মূল পরিকল্পনার নাম জানতে পারিনি। এক বছরে মামলার কোনো কূলকিনারা করতে না পারা পুলিশ প্রশাসনের কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

“হত্যাকারী যে দলেরই হোক, সে হত্যাকারী। সংগঠনের আড়ালে এনে তাকে রক্ষা করা ঠিক না।”

ছেলে হত্যার বিচার পেতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন

সুদীপ্ত হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন তার বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক বাবুল বিশ্বাস।

“প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার অনুরোধ আমার ছেলে অপরাধী ছিল না। কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম কিংবা টেন্ডারবাজির সাথে জড়িত ছিল না সে। তারপরও তাকে খুন হতে হয়েছে।

সুদীপ্ত হত্যার বিচার দাবিতে ছাত্রলীগের মানববন্ধন

বাবুল বিশ্বাসের অভিযোগ, “হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা হিসেবে গণমাধ্যমে যাদের নাম এসেছে তাদের কাউকে পুলিশ ধরেনি। তারা এখনও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে সুষ্ঠু বিচার হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না।”

কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, “বড় ছেলে হিসেবে সুদীপ্ত ছিল আমার অন্যতম অবলম্বন। পড়ালেখার পাট শেষ করে চাকরির চেষ্টা করছিল। তার ওপর অনেক ভরসাও ছিল।”

পরিবার চালাতে এখনও টিউশনি করতে হয় জানিয়ে তিনি বাবুল বিশ্বাস বলেন, “পরিবারে এখন আমিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমার ছোট ছেলে এখনও পড়াশোনা করে। অবসরের পাঁচ বছর পরও সংসার চালাতে প্রতিদিন প্রাইভেট টিউশন করি আর একটি স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করি।”

তিন দশকের বেশি সময় ধরে দক্ষিণ নালাপাড়ার যে বাসায় সুদীপ্তরা থাকতেন সেখানে আর থাকেন না বাবুল বিশ্বাস।

“৩২ বছরেরও বেশি সময় আমরা ওই বাসায় ছিলাম। সুদীপ্তকে হত্যার পর আর ওই বাসায় আমরা ফিরে যাইনি। মাঝে কিছুদিন পটিয়ায় গ্রামের বাড়িতে থাকলেও এখন শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি।”

“নালাপাড়ার বাসায় সুদীপ্তর স্মৃতি জড়িয়ে আছে, এখন আর যেতে ইচ্ছে করে না। তাই আর ওই বাসায় আমরা যাইনি।”

মৃত্যুর আগে যেন ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারেন, এটাই তার একমাত্র আকুতি।