সিডিএ অনুমতি পাওয়ার আগেই ৪৪টি গাছ কাটার জন্য চিহ্নিত করে ফেলেছে; অন্যদিকে নাগরিক অধিকার কর্মীরা দিচ্ছেন আন্দোলনের হুমকি।
Published : 01 Apr 2024, 12:40 AM
বন্দর নগরীর ‘আইকনিক’ সড়ক হিসেবে পরিচিত টাইগারপাস থেকে সিআরবিমুখী পাহাড়ি রাস্তাটির মাঝের ঢালে এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণ করতে চায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
সেজন্য জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে রেলওয়ের কাছে এবং পাহাড়ের ঢালে থাকা ৪৪টি গাছ কাটার অনুমতি চেয়ে বন বিভাগের কাছে আবেদনও করা হয়েছে।
ওই আবেদন অনুমোদন পেলে সেখানে তিন ডজনের বেশি শতবর্ষী গাছ কাটা পড়বে। সড়কটি হারাবে নান্দনিকতা। সে কারণে পরিবেশবাদী ও নাগরিক অধিকার কর্মীরা সিডিএ এর এই উদ্যোগকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলছেন। র্যাম্পটি নির্মাণের জন্য বিকল্প খুঁজে বের করার তাগিদ দিচ্ছেন।
নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা।
প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে নাম পাওয়া এ এক্সপ্রেসওয়ে গত বছরের নভেম্বরে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সময়মত কাজ শেষ করতে না পারায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে ওই সময়ের মধ্যেও পুরো কাজ শেষ হবে না।
এক্সপ্রেসওয়ের ১৪টি র্যাম্পের মধ্যে একটি জিইসি মোড়ে, দুটি টাইগারপাসে, চারটি আগ্রাবাদে, একটি ফকিরহাটে, দুটি নিমতলায়, দুটি সিইপিজেডে এবং দুটি কেইপিজেডে নির্মাণ করা হবে।
ছায়াঘেরা সড়কটিতে র্যাম্পের পরিকল্পনা
টাইগারপাস মোড়ে দুটি র্যাম্পের মধ্যে একটি হবে সিআরবি হয়ে নিউ মার্কেটমুখী সড়কে, অন্যটি হবে আমবাগানমুখী সড়কে।
দেওয়ানহাট ব্রিজের শেষ প্রান্ত সংলগ্ন অংশ থেকে টাইগারপাস মোড় ঘুরে সড়কের মাঝ বরাবর গিয়ে পলোগ্রাউন্ড বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের অংশ পর্যন্ত হবে যাবে প্রস্তাবিত র্যাম্পটি। এটি নির্মাণে ১৪ শতক জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে গত ২৫ মার্চ বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে চিঠি দিয়েছেন সিডিএ এর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস।
জানতে চাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এপ্রিলের মাঝমাঝি আমরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করতে চাই। তবে এখনো র্যাম্পের কাজ শেষ হয়নি। ছয়টি র্যাম্পের কাজ আমরা একসাথে শুরু করেছি। যেটির কাজ যখন শেষ হবে, সেটি চালু হবে।
“টাইগারপাসে দুটি র্যাম্প হবে। নিউ মার্কেট থেকে টাইগারপাসমুখী র্যাম্পটি ধরে গাড়ি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠবে। এতে করে নিউ মার্কেট এলাকা থেকে যেসব গাড়ি এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে চায় তাদের জন্য সহজ হবে। আর বিপরীতে আমবাগানমুখী র্যাম্পটি ধরে যানবাহান এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নামবে।”
কাজী হাসান বলেন, লালখান বাজারে গাড়ি নামার সুযোগ থাকবে। কিন্তু সেখানে ওঠার ব্যবস্থা থাকবে না। ওঠার জন্য আরেকটি র্যাম্প থাকবে জিইসি মোড় সংলগ্ন হোটেল পেনিনসুলার সামনে।
“১৫টি র্যাম্পই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে করা হয়েছে। যাতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সব এলাকা থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা-নামা করা যায়।”
টাইগারপাস থেকে সড়কটি সিআরবি পাহাড়ের পাশ দিয়ে চলে গেছে পলোগ্রাউন্ড ও বিআরটিসি মোড় হয়ে নিউ মার্কেটের দিকে। এই সড়কের টাইগারপাস থেকে পলোগ্রাউন্ড পর্যন্ত অংশে সড়কটি পাহাড়ের ঢালে উপরে ও নিচে।
এই সড়কের উপরের সিআরবি সংলগ্ন অংশটিতে গাড়ি চলে নিউ মার্কেটমুখী। আর নিচের রেলওয়ে কলোনি সংলগ্ন অংশটিতে গাড়ি চলে টাইগার পাসমুখী হয়ে। দুই সড়কের মাঝে পাহাড়ের ঢালে আছে শ খানেক বিভিন্ন আকারের গাছ।
পাহাড়ি ঢালের ওই অংশটিতেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণ করতে চায় সিডিএ। সেজন্য ওই ঢালে থাকা গাছগুলোর মধ্যে ৪৪টি গাছ কাটতে চায় সিডিএ।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিডিএ এর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বলেন, “দেখুন, উন্নয়ন কাজ করতে গেলে কিছু গাছ হয়ত কাটা পরে। কিন্তু বিপরীতে আমরা অনেক বেশি সংখ্যায় গাছ রোপণও করি। যেমন আউটার রিং রোডে ২০ হাজার গাছ কাটা পড়েছে। লাগানো হচ্ছে ৫ লাখ গাছ। এই প্রকল্পেও আমরা অনেক গাছ রোপণ করব।”
রেল কী বলছে
রেলওয়েকে দেওয়া চিঠিতে ‘প্রকল্পের অনুমোদিত এলাইনমেন্টের মধ্যে’ নগরীর আগ্রাবাদ থেকে বিমানবন্দরমুখী গাড়ি ওঠার র্যাম্প নির্মাণের জন্য শেখ মুজিব সড়ক সংলগ্ন ডেবারপাড় এলাকায় ২১ দশমিক ৭৭ শতক জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছে সিডিএ।
একই চিঠিতে পলোগ্রাউন্ড বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে থেকে টাইগারপাস হয়ে দেওয়ানহাটমুখী র্যাম্প নির্মাণের জন্য ১৪ শতক জমি ব্যবহারে অনুমতি চাওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিডিএ আমাদের কাছে জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছে। এ সংক্রান্ত পূর্ব রেলের ডিআরএম এর নেতৃত্বে আমাদের সাত সদস্যের একটি বিভাগীয় কমিটি আছে।
“নিয়ম অনুসারে, শুরুতে বিভাগীয় কমিটি জমিটি পরিদর্শন করবে। সেখানে কি পরিমাণ জমি আছে, কত গাছ আছে, গাছ কাটা হবে কিনা- সব বিষয় যাচাই করে বিভাগীয় কমিটি প্রতিবেদন দেবে। এরপর এখানকার প্রক্রিয়া শেষে অনুমোদনের জন্য সদর দপ্তরে যাবে। এটা হলো প্রক্রিয়া।”
চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মণ্ডিত এই সড়কে গাছ কেটে র্যাম্প নির্মাণে অনুমোদন দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে সুজন চৌধুরী বলেন, “এটা সরকারি অগ্রাধিকার প্রকল্প। বিভাগীয় কমিটির প্রতিবেদনের পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।”
তিনি বলেন, দেওয়ানহাট রেল সেতুর উপর দিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নেয়ার সময় রেলওয়ের ৭০ শতক জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিল সিডিএ। তখন এই র্যাম্পের জমির জন্য আবেদন করা হয়নি। এ আবেদনটি কয়েকদিন আগে করা হয়েছে।
গাছ চিহ্নিত করা শেষ
জমি ব্যবহারে রেলের অনুমতি এখনো না মিললেও বন বিভাগের কাছে গাছ কাটার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে সিডিএ। পাশাপাশি কোন গাছগুলো কাটা হবে তা ‘মার্কিং’ করার কাজও শেষ হয়েছে।
টাইগারপাস মোড় থেকে নিউমার্কেটমুখী ওই সড়কে গিয়ে দেখা যায়, টাইগারপাস মোড়ে বাঘের ভাস্কর্যের পরে বাঁ পাশের বড় গাছটিতে মার্কিং করা হয়েছে। এছাড়া পাহাড়ের উপরের সড়কটির মাঝের ঢালে বড় ও মাঝারি আকারের গাছগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই সড়ক ধরে এগিয়ে গেলে পলোগ্রাউন্ড বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে সামনের অংশ পর্যন্ত সড়ক বিভাজকেও লাল কালিতে কিছু সংখ্যা লেখা।
চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের শহর রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আব্দুল খালেক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিডিএ আমাদের কাছে একটি আবেদন করেছে। আবেদনের সাথে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটির সরকারি অনুমোদনের কাগজপত্রও দিয়েছে।
“৪৪টির মত গাছের উল্লেখ করা হয়েছে আবেদনে। আমরা ইনকোয়ারি করেছি। কেউ আবেদন করলে আমরা পরিদর্শনের মাধ্যমে গাছের তালিকা করে কাঠের পরিমাপ ও মূল্য নির্ধারণ করি। আমরা এখনো প্রতিবেদন দিইনি। এখন আমি অফিসের বাইরে আছি তাই বিস্তারিত বলতে পারছি না।”
গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে রেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, “গাছের মালিক হচ্ছে রেলওয়ে। সিডিএ রেলওয়ের কাছ থেকে অনুমতি নেবে। আমরা দেখব রেলওয়েকে তারা গাছের মূল্য পরিশোধ করেছে কিনা।”
সিডিএ এর গাছ কাটার উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের মেট্রো অঞ্চলের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিডিএ এর প্রকল্পে কী আছে, তা আমরা জানি না। আমাদের কেউ এ বিষয়ে কিছু জানায়নি।
“রেলের জমি হয়ে থাকলে তারা কি সিডিএকে গাছ কাটার অনুমতি দিয়েছে? কেউ অনুমতি দিয়েছে কিনা সে বিষয়েও আমাদের জানা নেই।”
আপত্তি পরিবেশবাদীদের
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পটি পলোগ্রাউন্ড মাঠ সংলগ্ন যে অংশ থেকে শুরু হবে তার পাশেই চট্টগ্রামের ‘ফুসফুস’ খ্যাত সিআরবির পাহাড়।
২০২১ সালের জুলাই মাসে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সিআরবিতে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য জমি বুঝিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলে শুরু হয় আন্দোলন ও প্রতিবাদ।
সেই আন্দোলন হয় নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের উদ্যোগে। টানা ১৫ মাস ধরে সেই আন্দোলন চলার পর সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিলের ঘোষণা আসে।
নাগরিক সমাজ চট্টগ্রামের যুগ্ম মহাসচিব সাংবাদিক মহসিন কাজী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেখানে র্যাম্প নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে শতবর্ষী বেশকিছু গাছ আছে। র্যাম্প হলে সেই গাছগুলো কাটা পড়বে।
“নান্দনিক একটি সড়ক, র্যাম্প নির্মাণের জন্য সিডিএকে অবশ্যই বিকল্প ভাবতে হবে। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধংসের কোনো অপচেষ্টা এই শহরের মানুষ মেনে নেবে না। প্রয়োজনে চট্টগ্রামের সব শ্রেণিপেশার মানুষকে নিয়ে আমরা আন্দোলনের ডাক দেব।”
পরিবেশবাদী সংগঠন পিপল’স ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো প্রকল্প গ্রহণের সময় শহরের প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েই তা করতে হয়। এটা সারা পৃথিবীতে অনুশীলন করা হয়।
“সিডিএ এর কর্তাব্যক্তিরা সকলেই চট্টগ্রামের মানুষ। তারা তো না জানার কথা নয় এই শহরে কোথায় কী আছে। এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়।”
শরীফ চৌহান বলেন, “পাহাড়ি ঢালের উপরে ও নিচে এরকম আইকনিক সড়ক চট্টগ্রামে এই একটিই আছে। সড়কের মাঝের অংশের গাছ কেটে র্যাম্প নামালে রাস্তাটির সৌন্দর্য আর থাকবে না।
“চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদরা চেষ্টা করলে এই সড়কটি রক্ষা করা সম্ভব। আশা করি তারা সচেষ্ট হবেন। সিডিএ এর কাছে অবিলম্বে র্যাম্পের নকশা পরিবর্তনের দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় আমরা আন্দোলনের পথে যাব।”
সিআরবি রক্ষার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম মুন্না বলেন, “এই রাস্তাটি চট্টগ্রাম শহরের ইউনিক ল্যান্ডস্কেপ। এই সড়ক দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আসে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরতে বিভিন্ন সময় নির্মিত তথ্যচিত্র গুলোতেও এই সড়কটি ঠাঁই পেয়েছে।
“ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথেও এই সড়ক জড়িত। যে গাছগুলো কাটার প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলো সিআরবির পাহাড়েরই বর্ধিত অংশের গাছ। এভাবে একটা সম্পদ নষ্ট করা যায় না। আন্দোলন করে পরিবেশ রক্ষার ঐতিহ্য চট্টগ্রামের আছে। প্রয়োজনে আমরা সেই পথেই যাব।”