পুরো পথেই দেখা গেছে মানুষের উচ্ছ্বাস। স্টেশনে থামার পর ট্রেনের ছাদেও চড়ে বসেছেন বহু মানুষ। কক্সবাজার স্টেশনে পৌঁছার পর উল্লাস ধ্বনিতে স্বাগত জানায় হাজারো মানুষ।
Published : 05 Nov 2023, 09:54 PM
কক্সবাজারের পথে ট্রেনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন না হলেও তবে পরীক্ষামূলক যাত্রায় প্রথমবারের মতো ‘কু ঝিক ঝিক’ শব্দে ট্রেন গেল সাগর কন্যার বুকে।
এই যাত্রা মানুষকে কতটা আন্দোলিত করেছে, তা দেখা গেছে রোববার। ফসলের মাঠ, নদী আর বনভূমি পেরিয়ে হুইসেল বাজিয়ে চলা ট্রেনটি দেখতে রেললাইনের দুই পাশে ছিল হাজারো মানুষের ভিড়।
লাইন ধরে ছুটে চলা ট্রেনের দুই পাশে দেখা গেলে শিশু-কিশোরদের দৌড়। সেই সঙ্গে চলছিল ছবি আর ভিডিও করার ‘প্রতিযোগিতা’। স্টেশনে স্টেশনে ছিল জনস্রোত।
আগামী ১১ নভেম্বর কক্সবাজারের পথে ট্রেন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সব ঠিকঠাক আছে কি না, তা জানতে রোববার চট্টগ্রাম থেকে হলো ট্রায়াল রান।
রেলের নিয়ম অনুসারে, কোনো নতুন রেলপথ নির্মাণ হলে তা পরিদর্শন করে পরিদর্শক দল। তাদের ইতিবাচক প্রতিবেদন পাওয়ার পরই ওই পথে রেল চলাচল শুরু হয়।
রোববার সকাল নয়টার একটু পর চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে পরিদর্শন ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়। ৯ ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ছয়টা ২০ মিনিটে ট্রেন যখন কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশনে পৌঁছায় তখন প্ল্যাটফর্মে হাজার খানেক মানুষের ভিড়। হাত নেড়ে তারা স্বাগত জানায় পরিদর্শন ট্রেনটিকে। ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় নিরাপত্তাকর্মীদের।
সরকারি রেল পরিদর্শক (জিআইবিআর) রুহুল কাদের আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ভালোভাবেই কক্সবাজারে পৌঁছেছি। লাইন ঠিক আছে। খুব স্মুথলি ট্রেন চলেছে। পরিদর্শন ট্রেন হওয়ায় আমরা ৫০ কিলোমিটারের বেশি গতি তুলিনি।”
পুরো পথে হাজারো মানুষের অভিনন্দন
ট্রেনটি বন্দর নগরী থেকে সাগর নগরীতে ঢুকতেই রেললাইনের দুই পাশে দেখা গেল আনন্দে সামিল হাজার হাজার মানুষ।
জেলার ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামাবাদ স্টেশনে পৌঁছার পর বহু মানুষ ঘিরে ধরল এক। আনন্দের আতিশয্যে কেউ কেউ উঠে পড়ল এর ছাদেও। এতে সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় চালককে।
এই প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া এবং কক্সবাজার সদর ও রামুতে প্রথমবারের মত রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চন্দনাইশের দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন আগে থেকে ছিল। এরপরের অংশ এই প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ হয়েছে।
যাত্রা শুরুর ৩০ মিনিটেই পরিদর্শন ট্রেনটি পৌঁছে যায় কালুরঘাট সেতু এলাকায়। ১৯৩০ সালে নির্মিত এই সেতু গত তিনমাস ধরে বন্ধ রেখে মেরামত করা হয়েছে ট্রেন চলাচলের জন্য।
ট্রেনটি যখন কালুরঘাট সেতুতে উঠল, তখনই আশেপাশের মানুষ কৌতুহল নিয়ে দেখল সেই চলাচল। তবে নিয়মিত ট্রেন চলাচল দেখা বোয়ালখালী উপজেলার মানুষের মধ্যে কক্সবাজারবাসীর মতো উচ্ছ্বাস ছিল না।
সাড়ে ১১টার দিকে চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী স্টেশনে পৌঁছতেই দেখা যায় অপেক্ষমান মানুষের ভিড়। এখান থেকেই শুরু কক্সবাজারমুখী নতুন ১০২ কিলোমিটার রেলপথের।
ট্রেন দেখতে আসা নিশান ইসলাম বলেন, “দোহাজারী পার হয়ে এই প্রথম কোনো ট্রেন কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছে। তাই সবাই দেখতে এসেছে। মানুষের মধ্যে অনেক আগ্রহ। সবাই খুশি।”
স্টেশন ম্যানেজার ইকবাল হোসেন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হলাম। এটা কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়।”
এরপর হুইসেল বাজিয়ে শঙ্খ নদী পেরিয়ে ট্রেন ছুটে চলে সাতকানিয়ার দিকে। দুই পাশের সবুজ মাঠ আর গ্রামীণ পথ পাড়ি দিয়ে এই যাত্রা ছিল মনোমুগ্ধকর। দুই পাশেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে মানুষ প্রথমবারের মতো দেখল ট্রেনের যাত্রা।
সাতকানিয়া উপজেলা পার হয়ে লোহাগাড়া উপজেলা। আর এখানেই শুরু চুনতি অভায়রণ্যের। এই বনের ভেতর দিয়েই গেছে রেল পথ।
অভায়রণ্যের ভেতর দিয়ে রেল চলাচলের পথে হাতির চলাচলের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ওভারপাস। নিচ দিয়ে চলে গেছে রেল লাইন। দুই পাশে বনের ভেতর দিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার চলে ট্রেন।
পথে স্টেশন এবং আন্ডারপাস এলাকায় রেললাইনসহ নানা অবকাঠামো পরিদর্শন করে রেলের পরিদর্শক দল।
এরপর ট্রেন লোহাগাড়া থেকে হারবাং স্টেশন পেরিয়ে ডুলাহাজারা পৌঁছে। সেখান থেকে যায় চকরিয়া স্টেশনে। পুরো পথ জুড়েই ছিল মানুষের ভিড়।
চকরিয়া স্টেশনেও শিশু-কিশোররা ছুটছিল ট্রেনের পাশাপাশি। আশেপাশের এলাকার বাসিন্দারাও জড়ো হন রেল লাইনের পাশে।
ডুলাহাজারা হয়ে ট্রেন পৌঁছে কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নে। এই স্টেশনেও হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষায় ছিল ট্রেন দেখতে।
সরকারি রেল পরিদর্শক (জিআইবিআর) রুহুল কাদের আজাদ বলেন, “সবখানেই ছিল উৎসুক জনতার ভিড়। উনারা আগে কখনো ট্রেন চলতে দেখেননি। যেখানেই যাই দুই পাশ থেকে লোকজন ট্রেন ঘিরে ফেলছিল। কিন্তু ইসলামাবাদ স্টেশনে ছিল সবচেয়ে বেশি ভিড়।
“সেখানে হাজার হাজার মানুষ। অনেকে ট্রেনের ছাদেও উঠে পড়ে। এখানে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে। তাও পরিদর্শনের পুরো কাজ আমরা শেষ করতে পারিনি। ভিড়ের কারণে কাজ করাই সম্ভব ছিল না।”
স্থানীয় বাসিন্দা লুৎফা বেগম আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, “আমরা আগে কখনো ট্রেন দেখিনি। তাই দেখতে এসেছি। খুব ভালো হলো। প্রধানমন্ত্রী হাসিনার কারণে এটা হয়েছে। আমরা খুশি। এখন আমরা ট্রেনে চড়তে পারব।”
এখানকার লোকজন ট্রেনের সঙ্গে ছবি তুলছিল। কেউ কেউ ট্রেনে উঠে দেখছিল। তারা হাত নেড়ে বিদায় জানায় পরিদর্শন ট্রেনটিকে।
ইসলামাবাদ থেকে রামু হয়ে কক্সবাজারের পথে যখন শেষ বিকেলে ছেড়ে যায় পরিদর্শন ট্রেনটি, তার অনেক আগে থেকেই কক্সবাজার স্টেশনে তৈরি হয় অপেক্ষমানদের ভিড়।
সন্ধ্যা ছয়টা ২০ মিনিটে ট্রেন যখন কক্সবাজার স্টেশনে প্রবেশ করছিল তখন সমবেতরা উল্লাস ধ্বনিতে ট্রেনকে স্বাগত জানায়।
নবনির্মিত আইকনিক স্টেশনে যখন ট্রেন পৌঁছে তখন চারপাশে আলো ম্লান করে জ্বলছিল স্থানীয়দের মুখের হাসি।
কক্সবাজারের বাসিন্দা সাইফুল আলম বলেন, “আমরা গত ছয় বছর ধরে অপেক্ষায় ছিলাম, কখন কক্সবাজারে ট্রেন আসবে। এই প্রথম নিজেদের শহরে কোনো ট্রেন দেখলাম। উদ্বোধনের পর কখন ট্রেনে চড়ে ঢাকা যাব সেই অপেক্ষায় আছি।”
সরকারি রেল পরিদর্শক (জিআইবিআর) রুহুল কাদের আজাদ বলেন, “আজ ভিড়ের কারণে প্রায় ৯ ঘণ্টায় আমরা চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পৌঁছেছি। তবে পরিদর্শনের সব কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। কাল ফেরার সময় বাকি কাজ শেষ করা হবে। তারপর আমরা প্রতিবেদন দেব।”
প্রকল্পের আদ্যোপান্ত
এ রেলপথ নির্মাণের আগে কক্সবাজারের সঙ্গে কোনো রেল যোগাযোগ ছিল না। শুরুতে এটি ছিল ‘দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ’ প্রকল্প। এতে মোট ১২৯ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণের কথা ছিল।
পরে রামু থেকে ঘুমধুম অংশের কাজ স্থগিত করা হয়। এখন চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে।
মোট ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা প্রকল্প সহায়তা দিয়েছে। বাকি ৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে।
প্রকল্পের জন্য কক্সবাজার জেলায় ১ হাজার ৩৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে নয়টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট এবং ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট।
গত আগস্টে পাহাড়ি ঢলে সাতকানিয়া এলাকায় এক কিলোমিটার এলাকায় রেল লাইনের নিচের মাটি সরে যাওয়ার কারণে রেল লাইনটি বেঁকে যায়। এ নিয়ে সে সময় উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়লেও রেলওয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি নয়। এটি সহজেই ঠিক করে ফেলা যাবে।