Published : 07 Oct 2024, 07:22 PM
চট্টগ্রাম জেলায় গত বছরের তুলনায় এবছর ৫৮টি দুর্গাপূজা কম হচ্ছে। আয়োজকদের ‘মানসিক অবস্থা ভালো না থাকায়’ ও ‘আর্থিক সমস্যার’ কারণে এসব পূজা হচ্ছে না বলে দাবি পূজা উদযাপন পরিষদের নেতাদের।
বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় আয়োজন দুর্গাপূজায় এবার চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার আশ্বাস হলেও গত কয়েক মাসের পরিস্থিতির কারণে অনেকের মনে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ভয় আছে বলে জানিয়েছেন সনাতন ধর্মের নেতৃস্থানীয়রা।
সব মিলিয়েই মণ্ডপে মণ্ডপে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। মণ্ডপগুলোতে গিয়ে খোঁজ খবরও নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পাশাপাশি বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দও মণ্ডপের নিরাপত্তায় সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
অন্য দিকে পূজার আয়োজকরা নিজ নিজ মণ্ডপের নিরাপত্তায় নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন, ক্লোজ সার্কিট ক্যামরা, রাত জেগে পাহারা এবং পূজা চলাকালে সার্বক্ষণিক প্রশাসন ও পুলিশের সাথে যোগাযোগ রাখার মত প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
চট্টগ্রাম জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি নিতাই প্রসাদ ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার চট্টগ্রাম জেলার সবগুলো উপজেলা মিলিয়ে মোট ১৫৯৪টি প্রতিমা পূজা হচ্ছে। আর ঘট পূজা হবে ৫২৮টি। প্রতিমা পূজার সংখ্যা গতবারের তুলনায় ৫০টির মত কমেছে। মন্দির বা সর্বজনীন পূজা তেমন কমেনি। যেসব পূজা এক ব্যক্তির উদ্যোগে বা স্থানীয় দুয়েকজন মিলে খোলা জায়গায় প্যান্ডেল বেঁধে করা হতো, সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি এবার হচ্ছে না।”
২০২৩ সালে জেলার উপজেলাগুলোতে প্রতিমা পূজার সংখ্যা ছিল ১৬৫১টি। আর ঘট পূজা হয়েছিল ৫২৪টি। সে হিসেবে উপজেলাগুলোতে চলতি বছর প্রতিমা পূজা কম হচ্ছে ৫৭টি।
দেবী দুর্গার প্রতিমা গড়ে পূজা করার পাশাপাশি দেবীর নিরাকার অবস্থার প্রতীক ঘটেও দুর্গাপূজা করা হয়ে থাকে; একেই ঘট পূজা বলে।
প্রতিমা পূজার সংখ্যা কমার বিষয়ে জানতে চাইলে নিতাই প্রসাদ ঘোষ বলেন, “গত কিছুদিন ধরে যা হচ্ছে তাতো সবাই জানেন। যারা পূজা করেন তাদের মানসিক অবস্থা সার্বিক কারণে ভালো নয়। কেউ কেউ আর্থিক সমস্যাতেও আছেন। মূলত এসব কারণেই পূজার সংখ্যা কমেছে।
“এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, জেলা প্রশাসন, বিজিবি, আনসারসহ সংশ্লিষ্ট সব সরকারি সংস্থা পূজা আয়োজনে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে। সর্বক্ষণ তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করছেন, নিয়মিত সভা করছেন। এখন পর্যন্ত জেলায় পূজা মণ্ডপ ঘিরে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি।”
৫৭টি পূজা কমলেও কোন উপজেলায় কতটি পূজা কমেছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য জানাতে পারেননি জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ সভাপতি নিতাই প্রসাদ ঘোষ।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “প্রায় সবগুলো উপজেলাতেই ৩-৪টি করে পূজা কমেছে। বেশিরভাগই প্রান্তিক এলাকায়। উপজেলা সদরে বা পৌরসভা এলাকায় তেমন পূজো কমেনি।”
দক্ষিণ জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রুবেল দেব বলেন, “বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এগিয়ে এসেছে। তারা মণ্ডপ পাহারায় স্বেচ্ছাসেবক দিবে বলেও জানিয়েছে। জেলা প্রশাসক, পুলিশের ডিআইজি, পুলিশ সুপারসহ শীর্ষ স্থানীয়দের সাথে আলোচনা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারাও সবসময় যোগাযোগ করছেন।
“তবে সবসময় কিছু দুষ্কৃতিকারী সমাজে থাকে। তারা হয়ত অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টায় আছে। আমরা সবাইকে নিয়ে সতর্ক আছি। আশা করি শান্তিপূর্ণভাবে পূজার আয়োজন সম্পন্ন করতে পারব।”
জেলার উপজেলাগুলোতে তথা গ্রামাঞ্চলে পূজার সংখ্যা কমলেও বন্দর নগরী চট্টগ্রামে এবার পূজার সংখ্যা একটি কমেছে। নগরীতে এবার ২৯২টি দুর্গা পূজার আয়োজন চলছে। গতবার পূজার সংখ্যা ছিল ২৯৩টি।
বন্দর নগরীতে সনাতন ধর্মালম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রম চট্টগ্রামের সম্পাদক স্বামী শক্তিনাথানন্দ পূজাপূর্ব পরিস্থিতির বিষয়ে বলেন, “পরশু এখানে এসেছিলেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য (অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান)। উনি পরিস্থিতি জানতে চাইলেন।
“আমি বলেছি- রামকৃষ্ণ মিশনে কিছু কখনো হয় না, হয়ত এবারও হবে না। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে শান্তি নেই। পূজা ও উৎসব যাদের নিয়ে সেই সেই ভক্তদের মনে যদি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকে তাহলে আমরা কাদের নিয়ে পূজা করব? ভক্তের মনে যদি দ্বিধা, সংকোচ ও ভয় থাকে তাহলে পূজা শান্তিপূর্ণ কীভাবে হয়?”
স্বামী শক্তিনাথানন্দ বলেন, “সব শুনে, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আশ্বস্ত করলেন যে, শান্তিপূর্ণভাবে পূজা হবে। প্রশাসন ও পুলিশের লোকজন নিয়মিত ফোন করে পূজার আয়োজন বিষয়ে জানতে চাইছেন। আমাদেরও নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক দল আছে।
চট্টগ্রাম নগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিল্লোল সেন উজ্জ্বলের কাছে প্রশ্ন ছিল ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে নগরীর কতটি মণ্ডপকে চিহ্নিত করা হয়েছে?
তিনি বলেন, “২০২১ সালে সব নিরাপত্তা থাকার পরেও বিজয়া দশমীর দিন সকালে জে এম সেন হলের পূজায় হামলা হয়েছিল। এরপর থেকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ বা অতি গুরুত্বপূর্ণ মণ্ডপ চিহ্নিত করার বিষয়টি বাদ দিয়েছি। এবার নগরীতে একটি পূজা কমেছে।
“আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং প্রশাসন আমাদের বারবার আশ্বাস দিচ্ছে। তবে উদ্বেগ আছেই। তাই আমরা প্রতিটি মণ্ডপে নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন ও সব মণ্ডপ সিসি ক্যামরার আওতায় আনার ব্যবস্থা করছি।”
এবার নগরীর মণ্ডপগুলোকে ডিজে মুক্ত ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পূজা উদযাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে জানিয়ে হিল্লোল সেন উজ্জ্বল বলেন, “সবাই যেন শৃঙ্খলা বজায় রেখে পূজার আয়োজন করে সে বিষয়ে ইতিমধ্যে বলা হয়েছে।”
এখন পর্যন্ত নগরীতে মণ্ডপ ঘিরে কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি বলেও জানান তিনি।